শিরোনাম
শুক্রবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

খুনিরা ছিল সব মেধাবী

মির্জা মেহেদী তমাল

খুনিরা ছিল সব মেধাবী

সুবীরের মন ভালো নেই। ভার্সিটিতে যায়, ক্লাস করে না। লনে, মাঠে একা বসে থাকে। তার মনের ভিতরে শুধু সনি। সনি তার প্রেমিকা। তার সব ভাবনাই যেন সনিকে ঘিরে। যাকে এতটাই ভালোবাসে সুবীর, সেই সনি কি না তার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে! ভার্সিটির মাঠের গাছতলায় বসে সুবীর এমন সব ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে যাচ্ছিল। বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা। সেদিকে খেয়াল নেই। সুবীর! পেছন থেকে সনির কণ্ঠ! হতচকিত হয়ে পড়ে সুবীর। পেছন ফিরে তাকাতেই সনিকে দেখে। ‘কী করছো সুবীর? ইদানীং   তুমি ক্লাসে যাচ্ছ না। কী হয়েছে, বল তো? শরীর খারাপ?’ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে যায় সনি। ‘না না! আমার কিছু হয়নি। ভালো লাগছিল না। এখন মন ভালো হয়ে গেছে। চলো আমরা কোথাও গিয়ে বসি। অনেক কথা আছে তোমার সঙ্গে।’- সুবীরের এমন প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায় সনি। তারা দ্রুত ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে পড়ে। তারা সুবীরের বাসায় যায়। সেখানে তারা সময় কাটায়। সুবীরের মন এখন খুব ভালো। পরদিন পিকনিকে যাবে। সনিও তার সঙ্গে যেতে রাজি হয়েছে। সনি আবারও আগের মতো করেই ভালোবাসতে শুরু করেছে সুবীরকে। সেদিন রাতে ফিরে যায় সনি। পরদিন তারা যায় পিকনিকে। সুবীরের এই পরিবর্তন বাসার লোকজনের চোখেও পড়ে। আবারও ক্লাসে নিয়মিত সুবীর। কিন্তু দুই দিনের বেশি এমন থাকে না। আবারও সনিকে নিয়ে তার আশঙ্কা। সনি আবারও দূরে দূরে। এক দিন ভার্সিটি থেকে বাসায় ফিরতে দেরি হচ্ছিল সুবীরের। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়। রাত বাড়তে থাকে। সুবীরের বাবা মাসহ পরিবারের সদস্যদের মনে অজানা আশঙ্কা। সারা রাত বিভিন্ন স্থানে খোঁজ করেও পাওয়া গেল না সুবীরকে। পরদিন সুবীরের বাবা থানা পুলিশের কাছে অভিযোগ করেন। সাধারণ ডায়েরি করেন তিনি। কিন্তু পুলিশ সন্ধান পায় না সুবীরের। সুবীরের বাবা মা অপেক্ষায় থাকে তাদের সন্তান ফিরবে। অপেক্ষার প্রহর যত দীর্ঘ হতে থাকে, সুবীরকে ফিরে পাওয়ার আশাটাও যেন ক্ষীণ হতে থাকে। একে একে দিন পেরিয়ে যায়। সুবীরের সন্ধান মেলে না। পুলিশ অনুসন্ধান করে চার যুবককে গ্রেফতার করলেও পরে তাদের থানা থেকে ছেড়ে দেয়। নিখোঁজের ১২ দিন পর সুবীরের সন্ধান মেলে। তবে জীবিত নয়, মৃত অবস্থায়। তার লাশ পাওয়া যায় ভাসমান অবস্থায় সাভারের ভাকুর্তার সলমাসী এলাকার তুরাগ নদের ঘাটে। অজ্ঞাত লাশ ভাসতে দেখে লোকজন পুলিশকে খবর দেয়। আস্তে আস্তে লাশ উদ্ধারের খবর গোটা এলাকায় চাউর হয়। লাশের খবর পান সুবীরের বাবা-মা। তারাও ছুটে যান সেই ঘাটে। ঘাটে লাশ ভাসতে দেখেই বাবা মা তাদের সন্তানকে চিনতে পারে। চিৎকার করে বলে, এটাই আমাদের সুবীর। আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সপ্তম সেমিস্টারের ছাত্র ছিল সুবীর দাস। সুবীরের বাবা গৌরাঙ্গ চন্দ্র দাস সাভার উপজেলা সমাজসেবা অফিসের মাঠকর্মী। ২০১৩ সালের ১২ জানুয়ারি সুবীর নিখোঁজ হয়। ১২ দিন পর তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। লাশ উদ্ধারের পর সুবীরের বাবা গৌরাঙ্গ চন্দ্র দাস বাদী হয়ে সুবীরের সহপাঠী লুৎফা আক্তার ওরফে সনি, শফিক আহমেদ ওরফে রবিন, ফয়সাল ওরফে  সেতু ও মো. ইউসুফকে আসামি করে সাভার থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। পুলিশ তদন্ত শুরু করে। লাশ উদ্ধারের দিনই ঢাকা থেকে চারজনকেই গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতারকৃতরা হচ্ছে মহাইমিনুল আহমেদ ফয়সাল ওরফে সেতু (২২), ইউসুফ আলী (২১), লুৎফা আক্তার সনি (২১) ও তার স্বামী শফিক আহম্মেদ রবিন (২৫)। এরা সবাই আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সপ্তম সেমিস্টারের ছাত্র। রাজধানীর  তেজগাঁও ও ধোলাইপাড় এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়। গোয়েন্দাদের তদন্তে বেরিয়ে আসে ত্রিভুজ প্রেমের কাহিনি। যেখানে নির্মমভাবে প্রেমের বলি হয়েছেন সহজ-সরল ও মেধাবী ছাত্র সুবীর দাস। আর যারা খুন করেছে, তারা তার সহপাঠী। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তারা। তবে সুবীরকে যে ইচ্ছায় দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিয়েছিল, সেই আশা পূরণ হয়নি খুনিদের। কারণ খুনিরা ধরা পড়েছে। বিচারিক আদালত চার খুনির মধ্যে দুজনকে মৃত্যুদন্ড ও অপর দুজনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করেছে। গোয়েন্দারা তদন্ত করে জানতে পারে, সুবীরের সহপাঠী লুৎফা আক্তার ওরফে সনির সঙ্গে তার গভীর প্রেমের সম্পর্ক ছিল। উভয়েই একে অপরের বাসায় যাতায়াত করত। কিন্তু ২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর লুৎফার সঙ্গে শফিক আহমেদের গোপনে বিয়ে হয়। যা সুবীর জানত না। সনি দুজনের সঙ্গেই প্রেম করত। লুৎফা এই গোপন বিয়ে সত্ত্বেও সুবীরের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ধরে রাখে। কিন্তু শফিকের কারণে সুবীরের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ কমিয়ে দিত। সুবীর গ্রিনরোডের একটি প্রাইভেট ফার্মে প্র্যাকটিস করত। ওই অফিসের স্টাফদের ১০ জানুয়ারি টাঙ্গাইলের মধুপুরে পিকনিক ছিল। সেখানে সুবীরের সঙ্গে সনিও যায়। এতে সুবীরের ওপর ভয়ানক ক্ষিপ্ত হন শফিক ওরফে রবিন। নাখালপাড়ার একটি বাসায় বসে তারা সুবীরকে হত্যার পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী কৌশলে শফিক ওরফে রবিন ১২ জানুয়ারি বিকালে বাসায় ফেরার পথে সাভার উপজেলা কোয়ার্টারের বাসার সামনে থেকে অপহরণ করেন সুবীরকে। সুবীর বাসায় ফিরে না এলে তার পিতা গৌরাঙ্গ চন্দ্র দাস সাভার থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। অবশেষে ১২ দিন পর ভাকুর্তা ইউনিয়নের টোটালীপাড়া এলাকার একটি ইট ভাটার কাছে বুড়িগঙ্গা নদীর পাড় থেকে সাভার থানা পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করে। সংবাদ পেয়ে সুবীরের পরিবারের সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশ শনাক্ত করে। বিচার : আহসানউল্লাহ ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির ছাত্র সুবীর চন্দ্র হত্যা মামলায় দুজনের ফাঁসির আদেশ দিয়েছে আদালত। একই ঘটনায় দুজনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও একজনকে খালাস প্রদান করা হয়। মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্তরা হলো ফরহাদ হোসেন সিজু (পলাতক) ও হাসান (পলাতক)। যাবজ্জীবন কারাদন্ডপ্রাপ্তরা হলো শফিক আহমেদ রবিন ও কামরুল আহসান শাওন। মামলার অন্য আসামি সনিকে খালাস প্রদান করেছে আদালত। ২০১৬ সালের ২৪ অক্টোবর মামলার রায় ঘোষণা করা হয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর