রবিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

লাশ ছিল সেপটিক ট্যাংকে

মির্জা মেহেদী তমাল

লাশ ছিল সেপটিক ট্যাংকে

‘হ্যালো! জি ভাই আমি মোক্তার বলছি। এই তো কয়েক দিন আগে বাহরাইন থেকে দেশে ফিরেছি। রিফাত আমার ছেলে। কেন ভাই, কী হয়েছে?’ অজ্ঞাত এক ব্যক্তির ফোনকলে একের পর এক প্রশ্নের জবাব দিয়ে যাচ্ছেন বাহরাইনপ্রবাসী মোক্তার মন্ডল। প্রশ্নের জবাব দিতে দিতেই তার হঠাৎ মনে হলো কেন এত জবাব দিচ্ছেন। লোকটির পরিচয়ই জানা হয়নি। এমন ভেবেই পরিচয় জানতে চান মোক্তার মন্ডল। লোকটি জবাব না দিয়ে বলে, ‘আপনার ছেলে রিফাত আমাদের জিম্মায়। জীবিত অবস্থায় ফেরত পেতে চাইলে ১৫ লাখ টাকা দিতে হবে। নইলে ছেলের লাশ পাঠিয়ে দেব।’ মোক্তার চিৎকার করে ওঠেন। বলেন, ‘ভাই, কী বলতাছেন! আমার ছেলে আপনাদের কাছে, মানে? কী বলেন! ১৫ লাখ টাকা! ভাই ভাই!’ ফোনের লাইন কেটে যায়। পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র রিফাতের এমন অপহরণের খবর পেয়ে পাগলপ্রায় বাবা-মাসহ পরিবারের লোকজন। বিভিন্ন স্থানে খোঁজখবর নিয়েও রিফাতের খোঁজ পায় না। পুলিশও তন্নতন্ন করে চষে বেড়াচ্ছে। সুখবর আসে না কোথা থেকেও। এটি রাজবাড়ীর ঘটনা। মিজানপুর ইউনিয়নের চরনারায়ণপুর গ্রামের মোক্তার মন্ডলের ছেলে রিফাত হোসেন অপহƒত হয় ২০১৩ সালে।

৬ নভেম্বর। সকালে স্কুলে যায় রিফাত। একে একে দিন যেতে থাকে। রিফাতের সন্ধান কেউ পায় না। পুলিশ রাজবাড়ীর সীমানা পেরিয়ে পাশের জেলাগুলোতেও তল্লাশি চালাতে থাকে। আবারও মুক্তিপণের টাকা চেয়ে মোক্তার মন্ডলের কাছে ফোন আসে। কিন্তু কোথায় কীভাবে টাকা দেওয়া হবে, এ বিষয় নিয়ে অপহরণকারীরা কিছু বলে না। মোক্তার মন্ডলের আত্মীয়স্বজন যে যেখানে ছিল চলে এসেছে রিফাতের খবর শুনে। কেউ যাচ্ছে পীর-ফকিরের কাছে, কেউ মাজারে। শিরনি-সদকা সবই করছে। কিন্তু খবর পাচ্ছে না রিফাতের।

রিফাত অপহরণের এ ঘটনাটি ধীরে ধীরে আলোচিত হয়ে উঠতে থাকে। সহপাঠীরা রাস্তায় নেমে মানববন্ধন করে। মিছিল-মিটিং চলতে থাকে। পুলিশের ওপর চাপ আসে ওপরমহল থেকে। পুলিশও ছুটছে এদিক-সেদিক।

মোক্তার মন্ডলের আপন ছোট ভাইকে পুলিশ আটক করে সন্দেহভাজন হিসেবে। পুলিশ ব্যাপক জেরা করে। কোনো তথ্য না পাওয়ায় তাকে জেলহাজতে পাঠানো হয়। পুলিশের কাছে খবর আসে স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ী রনির সাইকেলের পেছনে রিফাতকে দেখা গেছে। যেদিন নিখোঁজ হয় রিফাত সেদিনই তাকে দেখা যায়। গোয়েন্দারা খোঁজ নেন। তারা জানতে পারেন রনি নেই এলাকায়। শুধু রনি নয়, নেই রঞ্জন আর রাসেলও। এরা প্রত্যেকেই মাদক ব্যবসায়ী। পুলিশের সন্দেহ বাড়ে। গোয়েন্দারা তাদের সোর্সগুলো কাজে লাগাতে থাকেন। মোবাইল ফোন ট্র্যাকিং শুরু করেন। পুলিশ রঞ্জনের বাসায় যায়। রঞ্জনকে না পেয়ে তার এক আত্মীয়কে ধরে নিয়ে যায়। ইতিমধ্যে পাঁচ দিন পেরিয়ে যায়। পুলিশ জানতে পারে রঞ্জন একজন মুসলিম মেয়েকে নিয়ে পালিয়েছেন। তার অবস্থান ফরিদপুরের ভাঙ্গায়। এক খালার বাসায়। অভিযান চালানোর আগে সেখানকার কিছু সোর্সকে নজরদারিতে রাখতে বলে পুলিশ। সোর্সেরা সে বাসায় গিয়ে রঞ্জনের খোঁজ করেন। টের পেয়ে পেছনের দরজা দিয়ে প্রেমিকাকে নিয়ে পালান রঞ্জন। পালানোর সময় মাদারীপুরের বেশমপুরে স্থানীয় কিছু ছেলের হাতে রঞ্জন ধরা পড়েন প্রেমিকা সোহেলীসহ। তাদের মধ্যে মিলন নামে এক সন্ত্রাসীও ছিল। সে সোহেলীর কাছ থেকে তার চাচার নম্বর নেয়। চাচাকে ফোন দিয়ে সোহেলীর কথা জানায়। তাকে পেতে হলে ২০ হাজার টাকা বিকাশে পাঠাতে হবে বলে মিলন হুমকি দেয়। সোহেলীর চাচা দ্রুত সেই রাজবাড়ী পুলিশের কাছে খবর দেন। সোহেলীর চাচাও ইতিমধ্যে জেনে গিয়েছিলেন রঞ্জন রিফাত অপহরণের আসামি। পুলিশ মিলনকে ফোন করে জানায় রঞ্জনকে আটকে রাখতে। নইলে তাকে আসামি করা হবে বলে ভয় দেখায়। পুলিশ অভিযান চালায় মাদারীপুরে। সেখানে গিয়ে পাকড়াও করে রঞ্জনকে। এরপর তাকে জেরা করা হয়। পুলিশ জানতে চায় রিফাত কোথায়? রঞ্জনের জবাব, ‘রিফাত সেপটিক ট্যাংকে’। পুলিশ কর্মকর্তারা হতবাক। জীবিত পাওয়া গেল না শিশু রিফাতকে। ধরা পড়েন রনি আর রাসেল। অপহরণের সাত দিনের মাথায় শিশু রিফাতের বস্তাবন্দী লাশ উদ্ধার করা হয় সেপটিক ট্যাংক থেকে।

রঞ্জন জানান, অপহরণের দুই ঘণ্টার মধ্যেই শ্বাসরোধে হত্যা করা হয় রিফাতকে। তাকে রাখার কোনো জায়গা না থাকায় হত্যা করা হয় বলে জানান রঞ্জন। রাসেল জানান, রঞ্জন জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তারা একসঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলেন। একসময় রঞ্জন তাদের বুদ্ধি দেন প্রবাসী মোক্তারের ছেলে রিফাতকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করলে ১৫ লাখ টাকা পাওয়া যাবে। ভালোভাবে চলা যাবে। তারা রিফাতের বাসার আশপাশেই থাকেন। রনির যাতায়াত রয়েছে সে বাসায়। যে কারণে খুব সহজেই রিফাতকে নিয়ে আসা যাবে। এই রনি সাইকেলের লোভ দেখিয়ে রিফাতকে নিয়ে যায়। তবে রাসেল ধরা পড়েনি। রঞ্জন পুলিশকে জানান, অপহরণের পর শিশুটিকে নেশাজাতীয় ওষুধ খাইয়ে অচেতন করার পর ওইদিন রাতেই ঘরের মধ্যে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। এরপর লাশ প্লাস্টিকের বস্তায় ভরে প্রতিবেশী ভৈরব শীলের ল্যাট্রিনের হাউসের মধ্যে ডুবিয়ে রাখে।

পরে রিফাত হত্যায় জড়িত থাকার দায়ে দুজনকে ফাঁসি ও একজনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ডের আদেশ দেয় আদালত। রাজবাড়ীর অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক ওসমান হায়দার এ রায় দেন। ফাঁসির দন্ড পাওয়া দুজন হলেন রক্তিম ওরফে রঞ্জন (২৬) ও রাসেল (২৬)। যাবজ্জীবন দন্ড পান রনি (২৬)।

 

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর