শনিবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা
অষ্টম কলাম
জাতিসংঘের গবেষণা

যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে হত্যা-অপরাধ বৃদ্ধির কারণ ‘লকডাউন’

লাবলু আনসার, যুক্তরাষ্ট্র

জাতিসংঘের মাদক এবং অপরাধ সম্পর্কিত দফতরের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, লকডাউনের কারণে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে হত্যা, সন্ত্রাস, নৃশংসতা, সহিংসতাসহ নানা ধরনের অপরাধ বৃদ্ধি পেয়েছে। মনে করা হচ্ছে, করোনায় মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত হয়ে মানুষ এ ধরনের অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে।

গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, করোনার টিকা প্রদানের কার্যক্রম ব্যাপকভাবে পরিচালিত হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রে স্বাভাবিক অবস্থা ফেরার সঙ্গে সঙ্গে নির্বিচার বন্দুক হামলাসহ অন্যান্য সহিংসতা বেড়েছে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে গেছে বন্দুক-সহিংসতা এবং এটি সর্বকালের রেকর্ড ভেঙেছে সাম্প্রতিক সময়ে। যদিও করোনার প্রাদুর্ভাব চরমে উঠলে বেশ কটি দেশে এমন হত্যাযজ্ঞ, অথবা নৃশংসতার ঘটনা কমেছিল। করোনার তান্ডব হ্রাসের পাশাপাশি সেসব দেশে আবার সহিংসতা, বন্দুক-হামলা, হত্যাযজ্ঞের ঘটনা বেড়েছে। ২১ দেশের মাসিক অপরাধ-সম্পর্কিত তথ্য বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনার পর জাতিসংঘের গবেষকরা দেখতে পান, গত বছরের মার্চ-এপ্রিলে অধিকাংশ দেশেই নরহত্যা কমেছিল আগের তুলনায়। যদিও গ্রীষ্মের সময়ে পুনরায় তা বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে ইতালি ও স্পেনে সহিংসতা বেড়েছে গৃহদাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে। অন্যদিকে কলম্বিয়া, গুয়াতেমালায় সব সময়ই সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্রের তৎপরতা অব্যাহত ছিল। নিউজিল্যান্ড, যেখানে সবার আগেই করোনাভাইরাসের বিধিনিষেধ প্রত্যাহারের ঘটনা ঘটেছে, সেখানেও নরহত্যার ঘটনাবলিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। গবেষণায় জানা গেছে, নিউজিল্যান্ডে গত বছরের জানুয়ারিতে সহিংসতার ঘটনা ছিল ২৮ হাজার ৩৪২টি। করোনার তান্ডবে লকডাউনে যাওয়ার পর এপ্রিলে সে সংখ্যা কমে ১২ হাজার ৩২৩ হয়েছিল। এমন পরিস্থিতি বিশ্বযুদ্ধের সময়েও দেখা যায়নি। সবাই বাসায় বন্দী থাকায় চুরি-চামারির ঘটনাও সন্তোষজনকভাবে কমেছিল। লকডাউন প্রত্যাহারের সঙ্গে সঙ্গে অর্থাৎ গত জুনে নরহত্যার ঘটনা বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ, মে মাসের তুলনায়। তবে দীর্ঘমেয়াদে গুরুতর অপরাধের ঘটনা গত বছর কমেছে ৬.৫%। যদিও এখন পর্যন্ত নিউজিল্যান্ডে স্বাভাবিক অবস্থা ফেরেনি। জাতিসংঘ গবেষণা অনুযায়ী, বিভিন্ন দেশে লকডাউন কিংবা স্বাস্থ্যবিধির পরিপ্রেক্ষিতে অনেকেই সারাক্ষণ ঘরে থাকার কারণে গুরুতর অপরাধের মাত্রা কিছুটা কমেছে। অর্থাৎ চুরি-ডাকাতি-ছিনতাইয়ের ঘটনা কমেছে। কোনো কোনো দেশে শাটডাউনের সময়ে অপরাধের সুযোগ কম হয়েছে। ওসব দেশে অবশ্য করোনার বিধি শিথিল করার সঙ্গে সঙ্গে অপরাধের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। গবেষকরা মনে করছেন, লকডাউনের কারণে অনেকে আর্থিক সংকটে পড়েছে, ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির ছিল, বেকারের অভিশাপও চরমে ওঠে। লকডাউন শিথিল করার পর সে বিষয়টি অনেকের মধ্যে ক্ষোভ-হতাশা তৈরি করে বলেই অপরাধে প্রবৃত্ত হওয়ার ঘটনা বেড়েছে। কেউ কেউ অভাবে তাড়িত হয়েও চুরি-ডাকাতি-ছিনতাইয়ের পথ ধরে নৃশংসতায় লিপ্ত হচ্ছে।

জাতিসংঘের এই রিপোর্টে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, লকডাউনে অপরাধের মাত্রা কমলেও বর্তমানে স্বাস্থ্যবিধি শিথিল করায় তা আবার পুরনো স্টাইলে শুরু হয়েছে। সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্রের হত্যাযজ্ঞ যেমন বেড়েছে, তেমনি হিংসা-বিদ্বেষ এবং ঘৃণার বশবর্তী হয়ে হত্যাকান্ডও ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। চিলি, ইকুয়েডর, এলসালভেদর এবং হন্ডুরাসে করোনা মহামারীর সময় নরহত্যা কমেছিল আশাব্যঞ্জকভাবে। তবে জাতিসংঘের গবেষকরা অবশ্য নিশ্চিত হতে পারেননি যে, করোনার লকডাউনই তার একমাত্র কারণ কি না। এলসালভেদরের সরকার কর্তৃক গত বছরের শুরুতে অপরাধ চক্র গুঁড়িয়ে দেওয়ার অভিযান পরিচালিত হয়েছে। সেটিও একটি কারণ হতে পারে বলে গবেষকরা মনে করছেন। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক-সহিংসতা দূর হয়নি করোনাকালেও। অধিকন্তু আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি ছিল। নিম্ন আয়ের মানুষদের বসতি বেশি যেসব এলাকায় সেগুলোতে বন্দুক-সহিংসতা, নির্বিচার হত্যাযজ্ঞের ঘটনা একই ধারায় চলছে যুক্তরাষ্ট্রে। এর সঙ্গে স্বাস্থ্যবিধি শিথিলের ব্যাপারটিও প্রভাব ফেলেছে।

গবেষকদের অধিকাংশের ধারণা, করোনা-মহামারীকালে মানসিক চিকিৎসাসহ নানা জটিল রোগীরাও চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, এটিও হতাযজ্ঞ বৃদ্ধির একটি কারণ হতে পারে সারা আমেরিকায়। কানেকটিকাটের ইউনিভার্সিটি অব নিউ হ্যাভেনের ক্রিমিনাল জাস্টিস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মাইক লোলর এ প্রসঙ্গে বলেছেন, করোনায় মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়া মানুষের পক্ষেই এমন নৃশংসতায় প্রবৃত্ত হতে দেখা গেছে।

সর্বশেষ খবর