বুধবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

খুনকাণ্ডের নিপুণ কারিগর

মির্জা মেহেদী তমাল

খুনকাণ্ডের নিপুণ কারিগর

রেস্তোরাঁয় প্রচন্ড ভিড়। বিকাল থেকে রাত অবদি রেস্তোরাঁর টেবিল কখনই ফাঁকা পাওয়া যায় না। বিভিন্ন বয়সের মানুষ সেখানে যান। টেবিল দখল করে দীর্ঘ সময় ধরে চলে জম্পেশ আড্ডা। জায়গা না পেয়ে রেস্তোরাঁর বাইরেও গ্রুপ গ্রুপ করে আড্ডায় মেতে ওঠেন অনেকে। পরিবেশটা সেখানকার তুলনামূলক ভালো হওয়ায় মানুষের চাপ সেখানে একটু বেশি। হঠাৎ ধ্রæম ধ্রাম!! গুলির শব্দ! থেমে যায় মানুষের কথাবার্তা। পিনপতন নীরবতা। লোকজন বুঝতে পারছে না কিছু। কোনার টেবিলের দিকে চোখ যায় সবার। এক তরুণ দাঁড়িয়ে। উঁচু করে তোলা হাতে পিস্তল। এবার মানুষের ছোটাছুটি। যে যেভাবে পারছে রেস্তোরাঁ থেকে পড়িমরি করে ছুটছে। সবার লক্ষ্য রাস্তার দিকে। মুহূর্তে ফাঁকা রেস্তোরঁা। মেঝের ওপর পড়ে কাতরাচ্ছে শুধু এক যুবক। অস্ত্র হাতে পাশে দাঁড়ানো তার ঘাতক। ধীরে সুস্থে অস্ত্রধারী রক্তাক্ত যুবককে তার অস্ত্রের নিশানায় নিল। ট্রিগারে চাপ দিল। পরপর তিন বার। মৃত্যু নিশ্চিত করে ধীর পায়ে বেরিয়ে গেল রেস্তোরাঁ থেকে। এরপর হোটেলের লোকজন আবারও ভিতরে ঢুকল। পুলিশ এলো সংবাদ পেয়ে। রক্তাক্ত সেই যুবকটির দেহে প্রাণ নেই। লাশ মর্গে পাঠানোর ব্যবস্থা করল পুলিশ। এলিফ্যান্ট রোডের একটি রেস্তোরাঁয় গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল মিরপুরের গুদারাঘাটের টিপুকে। পুলিশের খাতায় টিপুও ছিলেন সন্ত্রাসী। টিপু তার বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে এসে খুন হন। তার প্রতিপক্ষরা তাকে অনুসরণ করে। তাদের সুযোগ-সুবিধা মতো তাকে খুন করে চলে যায়। পুলিশ তদন্ত করে। নানাভাবে বিভিন্ন মাধ্যমে গোয়েন্দারা জানতে পারে অস্ত্রধারী সেই হিটম্যানের নাম তারেক। তারেক সম্পর্কে পুলিশের কাছে অতীত কোনো রেকর্ড নেই। প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে ঘটনা শুনে গোয়েন্দারা হতবাক। দুর্ধর্ষ কোনো হিটম্যান ছাড়া এমন প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যার পর হেঁটে হেঁটে ঘটনাস্থল ত্যাগ করা সম্ভব নয়। কিন্তু হিটম্যান হিসেবে যার নাম আসছে, তার নাম গোয়েন্দারা প্রথম জানল। ঘটনাটি ২০০১ সালের। সংশিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ২০০২ সালের পর আন্ডারওয়ার্ল্ড উত্তপ্ত হতে থাকে। বেশ কয়েকটি খুনের ঘটনা ঘটে। খুন হন পুরান ঢাকার প্রভাবশালী শাহাদাত। পুলিশ তদন্ত শুরু করে। কিলার হিসেবে নাম পায় তারেকের। গোয়েন্দারা নড়েচড়ে বসে। তারেকের ব্যাপারে তদন্ত শুরু করে। এরপরই ঘটে একের পর এক খুন। মতিঝিলের দর্পণ, শাহজাহানপুরের রাজীব, আইনজীবী হাবিব মন্ডল, আগারগাঁওয়ে এসআই হুমায়ুন কবির, ছাত্রলীগ নেতা তপন, আঁখি, কমিশনার খালেদ ইমাম খুনেও ঘুরেফিরে সেই তারেকের নাম! খুনের ধরন দেখে পুলিশ ও গোয়েন্দারা নিজেরাই হতবাক। এমন দুর্ধর্ষ খুনির নাম কেন আগে এলো না পুলিশের খাতায়। এ নিয়েও পুলিশের চিন্তার যেন শেষ নেই। নীরব ঘাতক হিসেবেই আবির্ভাব ঘটে এই কিলারের, পুলিশের ভাষ্য। সূত্র জানায়, তারেকের বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি অন্য কাউকে দিয়ে খুন করাতেন না। নিজেই খুনের কাজটি নিপুণ হাতে করতেন। খুন করাটা তিনি শিল্প হিসাবেই মানতেন।

২০১৩ সালের ২৯ জুলাই রাজধানীর গুলশান শপার্স ওয়ার্ল্ডের উল্টোদিকের রাস্তায় ফিল্মি কায়দায় যুবলীগ নেতা রিয়াজুল হক খান মিল্কিকে গুলি করে হত্যা করে পালিয়ে যান। সিসি ক্যামেরার বদৌলতে যা দেশবাসী দেখেছে। এরপর থেকেই দেশবাসী চিনে তারেকের নাম। ঘাতক ওই যুবকের নাম তারেক। পুরো নাম এস এম জাহিদ সিদ্দিকী তারেক। আন্ডারওয়ার্ল্ডে যিনি সাইলেন্ট কিলার বা নীরব ঘাতক হিসেবে পরিচিত। তবে নিজেকে ‘কন্ট্রাক্ট হিটম্যান’ হিসেবেই পরিচয় দিতে ভালো বাসতেন। গোয়েন্দারা জানতে পারে, একটি খুনের জন্য তিনি পারিশ্রমিক নিতেন ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা। এভাবেই তিনি রাজধানীতে নীরবে ২৫ থেকে ৩০টি খুন করেছেন। মিল্কি হত্যাকান্ডটি প্রকাশ্যে করায় তিনি ধরা পড়ে যান। এর আগে পুলিশ প্রশাসনের কাছেও তার ব্যাপারে এমন ভয়ংকর তথ্য ছিল না। পুলিশ, গোয়েন্দা ও তারেকের এক সময়ের ঘনিষ্ঠ ছিলেন এমন বেশ কয়েকজনের বক্তব্যে তারেকের ভয়ংকর সব অপরাধের চিত্র ফুটে ওঠে। সূত্রগুলো জানায়, শীর্ষ সন্ত্রাসী অনেকের কাজ (কন্ট্রাক্ট কিলিং) করে দিত এই তারেক। ওর অস্ত্রভান্ডারে ছিল অত্যাধুনিক বিদেশি অস্ত্র। তারেকের গ্রামের বাড়ি সিলেটের হবিগঞ্জে। চার ভাই ও চার বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। বাবা আবদুল হাই। গ্রামের বাড়ি সিলেটে হলেও তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা মতিঝিলের এজিবি কলোনিতে। তারেকের শৈশব, কৈশোর, যৌবন ও রাজনৈতিক জীবন খুব কাছ থেকে দেখা এমন কয়েকজন নেতা-কর্মী বলেন, নব্বইয়ের দশকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির এক নেতার রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশ নেওয়ার মধ্য দিয়েই তারেকের রাজনৈতিক পথচলা শুরু। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ নির্যাতন ও নিগ্রহ থেকে বাঁচতে তারেক আশ্রয় নেন মিরপুরের তৎকালীন শীর্ষ সন্ত্রাসী কালা জাহাঙ্গীরের কাছে। সেই সূত্রে তারেকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠে বিদেশে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সঙ্গে। তারেকের কাজই ছিল এদের বিরোধীদের চিহ্নিত করে হত্যা করা। মিল্কি খুনের পর তারেক গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ধরা পড়েন উত্তরার একটি ক্লিনিক থেকে। এরপরই খিলক্ষেত এলাকায় র‌্যাবের ওপর হামলা চালিয়ে তাকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে তার সহযোগীরা। গুলিবিনিময়ের একপর্যায়ে নিহত হন পেশাদার এই কিলার তারেক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর