মঙ্গলবার, ৪ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

জীবিকায় থাবা বসিয়েছে করোনা, আয় তলানিতে

ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর

জীবিকায় থাবা বসিয়েছে করোনা, আয় তলানিতে

মহামারী করোনাভাইরাসে মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, দরিদ্র সব শ্রেণি-পেশার মানুষের আয়-রোজগার-সঞ্চয় তলানিতে নেমেছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর। তিনি ২০২১-২২ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে সামাজিক সুরক্ষায় সাতটি প্রস্তাবের কথা তুলে ধরে বলেন, সর্বজনীন পেনশন ভাতা, বেকার ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, শিশু প্রতিপালন ভাতা, আবাসন সুবিধা, আয়সহায়ক ভাতা ও স্বাস্থ্য ভাতা ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এর বাইরেও সংযুক্ত করা যেতে পারে প্রয়োজনীয় অন্যান্য ভাতা। গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন অন্বেষণের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর। তিনি বলেন, দেশের বিদ্যমান সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলো পর্যাপ্ত নয়। পেনশন ভাতা, সঞ্চয়পত্রের সুদ ইত্যাদি বাদ দিলে চলতি বরাদ্দ ২০১৯-২০ অর্থবছরের ৯ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ৭ দশমিক ৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা ও সুরক্ষা খাতের সুবিধাভোগী নির্বাচনে চরম অনিয়ম পরিলক্ষিত হয়েছে। এমনকি প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের কর্মচারীরা প্রত্যক্ষভাবে উপস্থিত থেকেও অনিয়ম সামাল দিতে পারেননি। কারণ কর্মসূচিগুলো সর্বজনীন নয়, নির্দিষ্ট দল বা গোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে নেওয়া। তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সুবিধাভোগী নির্বাচন রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট। আমলাতান্ত্রিক ব্যর্থতা আরও বড় চ্যালেঞ্জ। দরিদ্রদের কাছে পৌঁছানোর জন্য সঠিক ও সংগঠিত তথ্যের অভাবে সরকারের পক্ষে গত বছর করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে পৌঁছানো যায়নি ১০১ কোটি টাকা। তিনি বলেন, করোনায় মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, দরিদ্র সব শ্রেণি-পেশার মানুষের দুই বেলা খেয়ে-পরে বাঁচাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। দুর্ভোগ-দুশ্চিন্তা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। হাহাকার-দীর্ঘশ্বাস বাড়ছে। প্রথম ঢেউয়ের চেয়ে দ্বিতীয় ধাক্কায় অভিঘাত বেশি। নতুন দরিদ্র আরও বেড়েছে। শুধু দরিদ্র ও অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিতরা নয়, করোনা অধিকাংশ মানুষের জীবিকার ওপরই থাবা বসিয়েছে। দারিদ্র্য পরিস্থিতি বেড়ে দ্বিগুণ হলে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তের সংখ্যা অর্ধেকের বেশি কমে যাবে। মধ্যবিত্তের মাত্র ২০ শতাংশের মতো সরকারি চাকরি করেন। করোনার অভিঘাত দরিদ্রকে চরম দরিদ্র, মধ্যবিত্তকে নিম্নমধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তকে দরিদ্রে রূপান্তর করেছে।

খ্যাতনামা এই অর্থনীতিবিদ বলেন, দেশে সঠিক ও সংগঠিত তথ্যের অভাবে সরকারের পক্ষে গত বছর করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য বরাদ্দ ৪৩৯ কোটি টাকা দিতেই পারেনি সরকার। ১৫ লাখ পরিবারের কাছে টাকা পৌঁছানো যায়নি যথাযথ তথ্যভান্ডারের অভাবে। দেশের প্রথম দারিদ্র্য রেজিস্ট্রি তৈরির জন্য গৃহীত সরকারি প্রকল্পটি সাত বছরেও শেষ হয়নি। এর জন্য সংগৃহীত তথ্য ইতিমধ্যে অকেজো হয়ে গেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের (ডিডিএম) মধ্যে সহযোগিতায় বাস্তবায়িত এ প্রকল্পটি ২০১৩ সালের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। প্রথমে এটি ‘বাংলাদেশ দারিদ্র্য ডেটাবেস’ হিসেবে পরিচিতি পেলেও পরে নাম পরিবর্তন করা হয়। সরকার ও বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ৩২৮ কোটি টাকার ‘জাতীয় গৃহস্থালি ডাটাবেস’ (এনএইচডি) প্রকল্পটির শেষ সময়সীমা ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত বাড়িয়ে ৭২৭ কোটি টাকা হয়েছে। চার বছর সময় নেওয়ার পর বিবিএস ২০১৭-১৮ সালে তিনটি পর্যায়ে ৬৪ জেলা থেকে সাড়ে ৩ কোটি পরিবারের আর্থসামাজিক তথ্য সংগ্রহ করেছে। নির্বাচন কমিশনের তথ্যভান্ডারের সঙ্গে তথ্য মেলানো হয়। ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) তৈরি করতে গিয়ে প্রকল্পটি থমকে আছে। করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে তালিকাটিও পুরনো হয়ে গেছে।

অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশে স্বল্পপরিসরে সামাজিক নিরাপত্তা জাল ও সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প আছে। সামাজিক নিরাপত্তা জালের আওতায় অনেক প্রকল্প কখনো অ্যাডহক বা বছরের একটি নির্দিষ্ট মৌসুমের বা কোনো ক্রান্তিকালের জন্য। সারা বছর সুরক্ষা প্রদানের জন্য কার্যকর নয়। ব্যাপক পরিসরে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিও নেই। যেমন সামাজিক নিরাপত্তা জালের আওতায় স্তন্যদানকারী মায়েদের জন্য মাতৃত্বকালীন ভাতা শুধু ১০ শতাংশ জনসংখ্যার জন্য প্রযোজ্য। স্কুলগামী ছাত্রছাত্রীদের জন্য প্রদানকৃত বৃত্তি ও খাবার অপ্রতুল। এ ছাড়া বিধবা ও পরিত্যক্ত নারী ভাতা, অতিদরিদ্রদের কর্মসংস্থান, কাজের বিনিময়ে খাদ্য, বয়স্ক ভাতা, একটি বাড়ি একটি খামার ইত্যাদি প্রকল্প রয়েছে। দেশে বয়স্ক লোকের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ। ভাতা হিসেবে তাদের যে পরিমাণ অর্থ প্রদান করা হয় তা পর্যাপ্ত নয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের এই শিক্ষক বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, সামাজিক নিরাপত্তা জাল ও সামাজিক সুরক্ষার মধ্যে সুনির্দিষ্ট পার্থক্য আছে। মোটা দাগে, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে সরকার স্বল্প আয়ের অথবা আয়হীন মানুষকে অর্থ সাহায্য দেয়। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় অসহায় মানুষকে দুর্যোগ ও বিপর্যয় থেকে রক্ষার জন্য কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। সামাজিক নিরাপত্তা জাল ব্যবস্থায় অসহায় মানুষকে খাবার, নগদ টাকা, ভোগ্যপণ্য দিয়ে সাহায্য করা হয়।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর