বুধবার, ৫ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

পরিকল্পনা বিদেশি খুন দেশি

মির্জা মেহেদী তমাল

পরিকল্পনা বিদেশি খুন দেশি

৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায়ের আগেই সহপাঠীকে খুন করে দুই কিশোর। অপহৃত কিশোর তানভীরের লাশ একটি সেপটিক ট্যাংক থেকে উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতারের পর ঘাতকরা জানিয়েছে, তারা ভারতীয় সনি টিভি চ্যানেলের একটি সিরিয়াল দেখে অপহরণের মাধ্যমে মুক্তিপণ আদায়ের পরিকল্পনা করে। কিন্তু না পেয়ে তাদের সহপাঠী মাদরাসাছাত্র তানভীরকে হত্যা করে লুকিয়ে রাখে ট্যাংকিতে। ঘটনাটি নাটোর জেলার। চট্টগ্রামে আকবরশাহ থানার কালিরহাট এক নম্বর গলির ইদ্রিস সওদাগরের ভবনের নিচতলা থেকে হাসিনা বেগম নামে এক পোশাক কর্মীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এরপর দেবর ফরহাদ হোসেন লিমনকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেওয়া হলে ভাবিকে হত্যার কথা স্বীকার করেন তিনি। লিমন ভারতীয় টিভি চ্যানেল সনি আটের শো ’ক্রাইম প্যাট্রল’ দেখে প্রভাবিত হয়ে ভাবিকে হত্যার পর চুরির ঘটনা সাজানোর চেষ্টা করে বলে পুলিশকে জানায়। সংশ্লিষ্টরা বলছে, সুপারম্যান দেখে ছাদ থেকে লাফ দিয়ে ওড়ার চেষ্টা করা কিংবা সোর্ড অব টিপু সুলতানের অনুকরণে কাঠের তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা করতে গিয়ে দুর্ঘটনা আগেও ঘটেছে। আবার ভারতীয় টিভি সিরিয়াল দেখতে না দেওয়ায় পাখি এবং কিরণমালা জামা কিনে না দেওয়ায় তরুণীদের আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটছে আজকাল। এরই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ ভারতীয় একটি টিভি সিরিয়ালের অনুকরণে খুনাখুনির ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে।

নাটোরে কিশোর তানভীর খুনের ঘটনায় গ্রেফতার কিশোর হুসাইদ হোসেন (১৫), বাইজিদ হাসান (১৪) ও নাঈম হোসেন ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায়ের জন্য তানভীরকে হত্যা করে লাশ গুম করার কথা স্বীকার করে। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী জেলা শহরের আলাইপুর আশরাফুল উলুম হাফিজিয়া মাদরাসার পাশে এক বাড়ির টয়লেটের সেপটিক ট্যাংক থেকে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)-৫ তানভীরের লাশ উদ্ধার করে। নাটোর সদর থানা ও র‌্যাব সূত্রে জানা যায়, শহরের উত্তর বড়গাছা হাফরাস্তা এলাকার সাইফুল ইসলামের পুত্র তানভীর হোসেন (১১) চার বছর ধরে আলাইপুর আশরাফুল উলুম হাফিজিয়া মাদরাসায় পড়ালেখা করছিল। এর মধ্যে সে ৯ পারার হাফেজ হয়েছে। এক দুপুরে তার মা ফিরোজা বেগম ও বাবা সাইফুল ইসলাম ওরফে তুষার মাদরাসায় গিয়ে তাদের একমাত্র সন্তানকে নিজের হাতে দুপুরের খাবার খাইয়ে দিয়ে আসেন। রাতে খাবার নিয়ে যাওয়ার পর মাদরাসায় তাকে আর পাওয়া যায়নি। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও তাকে না পেয়ে ওই রাতেই সাইফুল ইসলাম সদর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। তিন দিন পর মুঠোফোনে তানভীরকে অপহরণ করা হয়েছে বলে বাবাকে জানিয়ে মুক্তিপণ হিসেবে ৫ লাখ টাকা দাবি করা হয়। টাকা দেওয়ার আগে ছেলের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে অপহরণকারীদের একজন ছদ্মবেশে কথা বললে সাইফুল বুঝতে পারেন যে ওই কণ্ঠ তার ছেলের নয়। তখন তিনি ঘটনাটি র‌্যাবের সদর দফতরে জানান। র‌্যাব সদস্যরা মুঠোফোনে আড়ি পেতে অপহরণের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে তানভীরের সহপাঠী সিংড়া উপজেলার জোড়মল্লিক গ্রামের মোক্তার হোসেনের পুত্র হুসাইদ হোসেন ও বাগাতিপাড়া উপজেলার নওপাড়া গ্রামের বাবুল হাসানের পুত্র বাইজিদ হাসানকে আটক করে। পরে স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে তাদের সহযোগী শহরের কালুরমোড়ের আবদুর রহিমের পুত্র নাঈম হোসেনকেও আটক করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনজনই তানভীরকে হত্যা করে মাদরাসার পাশে জনৈক আবুল কাশেমের টয়লেটের কাঁচা সেপটিক ট্যাংকে লাশ গুম করার কথা জানায়।

ভারতীয় সিরিয়াল দেখে পরিকল্পনা র‌্যাবের হাতে আটক হুসাইদ হাসান মঙ্গলবার সকালে গণমাধ্যম কর্মীদের জানায়, তারা ভারতীয় সনি টিভি চ্যানেলের একটি সিরিয়াল দেখে অপহরণের মাধ্যমে মুক্তিপণ আদায়ের পরিকল্পনা করে। এ জন্য তারা তাদের সহপাঠী তানভীরকে বেছে নেয়। কারণ সে বাবা-মার একমাত্র সন্তান। খুব সহজেই টাকা পাওয়া যাবে। গত ২১ আগস্ট তারা তাদের বন্ধু নাঈমের দোকানে গিয়ে অপহরণ ও খুনের পরিকল্পনা করে।

আটক বাইজিদ হাসান জানায়, তারা ঝামেলা এড়াতে তানভীরকে প্রথমেই খুন করার পরিকল্পনা করে। সে মোতাবেক আসরের নামাজের পর সে আর হুসাইদ নতুন মোবাইল ফোনসেট দেখার কথা বলে তানভীরকে মাদরাসা থেকে পাশের একটি পরিত্যক্ত ঘরে নিয়ে যায়। সেখানে রশি দিয়ে তাকে ফাঁস দিয়ে শ্বাসরোধ করার চেষ্টা করে। কিন্তু তাতেও তার মৃত্যু না হলে তারা গলায় খুর চালায়। এতে তার মৃত্যু নিশ্চিত হয়। সেখান থেকে তারা বন্ধু নাঈমের দোকানে গিয়ে তাদের গায়ে লেগে থাকা রক্ত পরিষ্কার করে মাদরাসায় ফিরে আসে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক (সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক) তৌহিদুল হক বলেন, সমাজের নানা স্তরে অনাচার, পাশবিকতা এবং অশুভ শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে নৈরাজ্য বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ছে। সমাজের ভিতরে ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে নানা ক্ষেত্রে। বিভিন্নভাবে এর প্রকাশ ঘটতে থাকবে। অবক্ষয়ের যে জোয়ার চলছে তাতে ভবিষ্যতে আরও নানা ধরনের অনাচার, নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা এবং শিউরে ওঠার মতো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটতে পারে। এ থেকে মুক্তি পেতে হলে পরিবার, সমাজ যে যেখানে আমরা দায়িত্বশীল আছি তাদের সবাইকে দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে হবে। সবাইকে সবার খোঁজখবর সঠিকভাবে রাখতে হবে, যাতে কেউ চোখের আড়ালে কোনো অপরাধে জড়িয়ে পড়তে না পারে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর