সোমবার, ১০ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

মাটিচাপা লাশের ওপরে কচু চাষ

মির্জা মেহেদী তমাল

মাটিচাপা লাশের ওপরে কচু চাষ

রাসেলকে মুঠোফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। তার স্ত্রী যতবার ফোন দিচ্ছে, ততবারই ফোনের সুইচ অফ বলছে। রাত পেরিয়ে যায়। রাসেলের খবর নেই। ইলেকট্র্রিক সামগ্রীর ব্যবসায়ী মাহবুব আলম রাসেলের চিন্তায় পরিবারের সদস্যরা ভেঙে পড়েছেন। তার ঘনিষ্ঠ দুই বন্ধুকেও খুঁজে পাচ্ছেন না তারা। যে কারণে রাসেল কোথায় আছে তা জানা যাচ্ছে না।

মাহবুব আলম রাসেল, জ্যোতির্ময় জয় ও সাব্বির হোসেন। তারা একে অপরের বন্ধু। বন্ধুত্বের এই বন্ধন যে এভাবে ছিন্ন হবে তা ভাবতেও পারেননি রাসেলের বাবা মকবুল হোসেন। কিন্তু তা-ই সত্যি হলো। রাজশাহী মেডিকেল কলেজের দুই ছাত্রবন্ধু জয় ও সাব্বিরের হাতেই খুন হন রাজশাহী কলেজের ছাত্র ও ব্যবসায়ী রাসেল। মেডিকেলের ছাত্র জয় গোপনে কঙ্কালের ব্যবসা করতেন। কঙ্কালের জন্যই নির্মমভাবে হত্যা করেন দীর্ঘদিনের বন্ধু রাসেলকে। হত্যার পর লাশ মাটিতে পুঁতে রেখে কচুগাছ লাগিয়ে দেন। ঘটনাটি ২০১১ সালের এপ্রিলের। কঙ্কালের জন্য মেডিকেলের দুই ছাত্র তাদেরই ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনাটি সারা দেশে তোলপাড় শুরু হয়।

নাটোরের লালপুর উপজেলার মকবুল হোসেনের এক ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে রাসেল ছিলেন ছোট। ২০০৩ সালে নাটোরের করিমপুর উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে নাটোর ক্যান্টনমেন্ট কলেজে ভর্তি হন। এরপর সেখান থেকে ২০০৫ সালে এইচএসসি পাস করে অনার্স পড়ার জন্য রাজশাহী কলেজে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন। ছাত্র থাকা অবস্থায়ই ২০০৮ সালের ১৬ এপ্রিল তিনি বিয়ে করেন। বিয়ের পর রাসেল এলাকায় ইলেকট্রনিকসের দোকান দেন। সেই সময়ে তার শিশু সন্তানের বয়স ছিল আড়াই বছর। জয় নাটোরের বাগাতিপাড়া গ্রামের জগদীশ চন্দ্র সরকারের ছেলে। তিনি রাজশাহী মেডিকেল কলেজের পঞ্চম বর্ষের (৪৭তম ব্যাচ) ছাত্র ছিলেন। তার সহপাঠী সাব্বির গাজীপুর জেলার মৃত শাহাদত হোসেনের ছেলে। তাদের পরিবার ঢাকায় থাকে।

রাসেলের বাবা মকবুল হোসেন পুলিশকে জানিয়েছিলেন, জয় হিন্দু সম্প্রদায়ের ছেলে হলেও নাটোর ক্যান্টনমেন্ট কলেজে একাদশ শ্রেণিতে একসঙ্গে পড়ার সময় রাসেলের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। এরপর এইচএসসি পাস করে রাসেল রাজশাহী কলেজে অর্থনীতিতে এবং জয় রাজশাহী মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়। সেই সুবাদে মাঝে-মধ্যেই জয় তাদের বাসায় যাতায়াত করত। একপর্যায়ে জয়ের বন্ধু সাব্বিরের সঙ্গেও বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে রাসেলের। জয় ও সাব্বির ঠিকাদারি ব্যবসা এবং কোচিং সেন্টার খোলার নাম করে প্রায় ১০ লাখ টাকা রাসেলের কাছ থেকে ধার নিয়েছিল। এই টাকা পরিশোধের জন্য রাসেল মাঝে-মধ্যেই তাদের বলত। রাসেলের পরিবার জানত যে, সেই বছরের ৪ এপ্রিল দোকানের মালামাল কেনার নাম করে রাসেল তার বন্ধু জয় ও সাব্বিরের সঙ্গে নাটোরের আবদুলপুর রেলস্টেশন থেকে বিকাল ৫টার সময় পদ্মা ট্রেনে চড়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেবে। ওই দিন সন্ধ্যা ৭টায় ছেলের সঙ্গে কথা হয় মকবুলের। রাত ১০টার দিকে রাসেলের ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। পরদিনও রাসেলের ফোন বন্ধ পাওয়ায় তিনি সাব্বিরকে ফোন করেন। তখন সাব্বির তাকে জানিয়েছিলেন, রাসেল ভালো আছে, কোনো সমস্যা হয়নি। চার্জ না থাকায় তার মোবাইল ফোনটি বন্ধ হয়ে আছে। সে খুব ব্যস্ত থাকায় কথা বলতে পারছে না বলেও জয় মকবুল হোসেনকে জানায়। এরপর মকবুল হোসেনের সঙ্গে জয় ও সাব্বির এভাবে আরও কয়েকবার প্রতারণা করতে থাকেন। সর্বশেষ জয়ের সঙ্গে ৭ এপ্রিল কথা হয় মকবুল হোসেনের। রাসেলের ফোন বন্ধ থাকার পর যখন জয় ও সাব্বিরের মোবাইলও বন্ধ হয়ে যায়, তখন তাদের সন্দেহ হয়। এরপর রাসেলের পরিবারের লোকজন ধারণা করেন, তাকে জয় ও সাব্বির অপহরণ করেছে। কোনোমতেই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারায় গত ১৫ এপ্রিল রাসেলের বাবা লালপুর থানায় জয় ও সাব্বিরের নামে একটি অপহরণ মামলা করেন।

জয় ও সাব্বির দুজনই রাজশাহী মেডিকেল কলেজে পড়ে বলে মামলাটি হাতে পাওয়ার পর লালপুর থানা থেকে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। এরপর মোবাইল ট্র্যাকারের মাধ্যমে জয়কে ভোর ৩টার দিকে র‌্যাব-৫ সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে। রাতে তাকে লালপুর থানায় হস্তান্তর করা হয়। জয়ের দেওয়া তথ্য উল্লেখ করে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, রাসেলকে হত্যার পর গত ৯ এপ্রিল সাব্বির ও ১০ এপ্রিল জয় রাজশাহী ছেড়ে পালিয়ে যান। জয়ের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী র‌্যাব নিশ্চিত হয়, এই হত্যাকান্ডের সঙ্গে জয় ও সাব্বির জড়িত। রাসেলকে হত্যা করার জন্য সাব্বির ও জয় ২০১১ সালের মার্চের শেষ সপ্তাহে পরিকল্পনা আঁটেন।

জয়কে জেরা করে পুলিশ জানতে পারে, রাসেল আইপিএলের বাজি জিতে সাব্বিরের কাছে ৩ লাখ টাকা পেতেন। তা ছাড়া ১৫ শতাংশ সুদে ধার  নেওয়া দেড় লাখ টাকা পেতেন জয়ের কাছেও। ওই টাকা পরিশোধে চাপ দেওয়ায় জয় ও সাব্বির ২০১১ সালের ৪ এপ্রিল রাসেলকে নাটোরের আবদুলপুর বাজারে তার ইলেকট্রনিকসের দোকান থেকে ডেকে নিয়ে আসেন। এরপর ওই দিনই রাত ১২টার দিকে তারা রাসেলকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চারু মামার ক্যান্টিনের সামনে নিয়ে যান। সেখানে ক্যান্টিনের সামনে বসে তারা তিনজন তিনটি ফেনসিডিল পান করেন। রাসেলকে তারা ফেনসিডিলের যে বোতলটি পান করতে দিয়েছিলেন তাতে ঘুমের ওষুধ মেশানো ছিল। এ কারণে রাসেল ফেনসিডিল পানের কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েন। এরপর রাসেলকে হত্যা করার জন্য তার শরীরে সাব্বির বিষজাতীয় ইনজেকশন পুশ করেন। ১০ মিনিট পর রাসেল মারা যান। এরপর জয় ও সাব্বির দুজনে মিলে রাসেলের লাশ চারু মামার ক্যান্টিনের পেছনে নিয়ে ড্রেনের স্লাব ও মাটি তুলে সেখানে ফেলে দেন। দ্রুত পচে যাওয়ার জন্য লাশের ওপর প্রথমে সিমেন্ট ও কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। এরপর মাটিচাপা দিয়ে কচুগাছ লাগানো হয়।

যেভাবে উদ্ধার হলো লাশ : জয়কে নিয়ে র‌্যাবের একটি দল ২২ এপ্রিল দুপুর ২টার দিকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের চারু মামার ক্যান্টিন এলাকায় যায়। কলেজের মূল ভবন থেকে ১০ হাত দূরে উত্তর পাশে চারু মামার ক্যান্টিন। ক্যান্টিনের পেছনে মাটি আর পানিতে ভরে যাওয়া একটি ড্রেন। সব সময় পানি জমে থাকে বলে কচুগাছও বড় হয়ে গেছে। এই কচুগাছের মধ্যে সামান্য একটু আলগা করা মাটি। তার ওপর চাপানো রয়েছে ছোট ভাঙা একটি স্লাব। জয় নিজে স্লাবটি টেনে তুলতেই লাশের পচা গন্ধ বের হতে থাকে। পরে ডোম ডেকে রাসেলের লাশ তোলা হয়। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন এমন এক কর্মকর্তা জানান, জয় মানুষের কঙ্কালের ব্যবসা করতেন। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ থেকে কঙ্কাল কিনে নিয়ে অন্য জায়গায় বিক্রি করতেন। এই ব্যবসার জন্য তিনি রাসেলের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছিলেন।

সর্বশেষ খবর