সোমবার, ১৭ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

খুনির হাতে তুলে দিলেন বাবা

মির্জা মেহেদী তমাল

খুনির হাতে তুলে দিলেন বাবা

১৬ বছরের বিউটি আক্তারের লাশ ভেসে ওঠে হবিগঞ্জের লাখাই হাওরে। তার শরীরে ছোট-বড় ৫টি আঘাতের চিহ্ন। দুর্বৃৃত্তরা বিউটিকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে নির্দয়ভাবে খুন করে ফেলে রেখে যায়। ২০১৮ সালের ১৮ মার্চ লাশ উদ্ধারের পর পুলিশকে ভাবিয়ে তোলে। কারণ, ঘটনার তিন মাস আগে এই বিউটিকেই তুলে নিয়ে যায় শায়েস্তাগঞ্জের বাবুল মিয়া। ১৭ দিন পর পুলিশ তাকে উদ্ধার করে। বাবুল মিয়ার বিরুদ্ধে আটকে রেখে ধর্ষণ মামলা দায়ের করা হয়। মূলত বাবুলের কাছ থেকে নিরাপদে রাখতেই বিউটিকে তার নানির বাড়িতে রেখে আসে তার বাবা ছায়েদ আলী। কিন্তু নানির বাড়িতেও নিরাপদ থাকেনি মেয়েটি। তিন দিনের মধ্যেই তাকে নৃশংস খুনের শিকার হতে হলো। মেয়ের লাশ উদ্ধারের পর ছায়েদ আলী দিশাহারা। শোকে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে পুরো পরিবার। পুলিশ এসে তদন্ত শুরু করে। ছায়েদ আলীর সন্দেহের তীর শায়েস্তাগঞ্জের সেই বাবুল মিয়ার দিকেই। তাকেই খুনের আসামি করে মামলা দায়ের করেন ছায়েদ আলী। অপহরণ  ও ধর্ষণের মামলায় বাবুল মিয়া গ্রেফতার না হলেও খুনের পর পুলিশ নড়েচড়ে বসে। তাকে গ্রেফতারে পুলিশ ও র‌্যাব মরিয়া। তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ খুঁজে পায় চাঞ্চল্যকর তথ্য। যে তথ্য জেনে পুলিশ ও গোয়েন্দারা হতবাক। হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ ওলিপুরের ইউপি মহিলা মেম্বার কলম চাঁনের ছেলে বাবুল মিয়া একটি কোম্পানিতে চাকরি করে। বেশ কিছুদিন আগে এক প্রবাসীর স্ত্রীকে বিয়ে করে বাবুল। প্রভাবশালী বাবুলের এক পর্যায়ে নজর পড়ে বিউটির ওপর। তাকে কোম্পানিতে চাকরি দেবে বলে প্রলোভন দেখায় এবং প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে। ২০১৮ সালের ২১ জানুয়ারি বাবুল মিয়া প্রেমের ফাঁদে ফেলে বিউটিকে বাড়ি থেকে নিয়ে যায়। স্ত্রী পরিচয় দিয়ে ওলিপুরের একটি ভাড়া বাসায় বিউটিকে নিয়ে ওঠে। ১৭ দিন সেখানে বিউটিকে আটকে রাখে। ৯ ফেব্রুয়ারি তাকে উদ্ধার করা হয়। এরপর বিউটিকে বিয়ে করার জন্য দুই দফায় গ্রাম্য সালিশ ডাকা হলেও বিষয়টি অমীমাংসিত থেকে যায়। বিউটিকে বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানায় বাবুল। এতে হবিগঞ্জ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতে ৪ মার্চ বিউটিকে অপহরণসহ ধর্ষণের অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়। পরে মামলাটি শায়েস্তাগঞ্জ থানায় এফআইআর করা হয়। সেই মামলায় সাক্ষী হিসেবে ছিলেন বিউটির বাবা ছায়েদ আলীর দূরসম্পর্কের ভাই ময়না মিয়া। এর মধ্যে ১২ মার্চ বিউটিকে থানায় নেওয়া হয়। মেডিকেল পরীক্ষার পর সে আদালতে ২২ ধারায় জবানবন্দি দেয়। সেখানে বিউটি বলে, সে স্বেচ্ছায় বাবুলের সঙ্গে গিয়েছিল এবং বাবুল তাকে বিয়ে করলে সে মামলা তুলে  নেবে। বাড়িতে বিউটিকে এনে দিশাহারা হয়ে পড়ে ছায়েদ। পরে বিউটিকে নিকটস্থ লাখাইয়ের গুণিপুর গ্রামে তার নানি ফাতেমা বেগমের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তিন দিন পর বিউটির লাশ উদ্ধার করা হয় হাওর থেকে। বিউটির বাবার অভিযোগ, তার মেয়েকে খুন করেছে ধর্ষক বাবুল মিয়া। পুলিশও এক প্রকার নিশ্চিত খুন করেছে বাবুল মিয়া।

পুলিশ ২১ মার্চ বাবুলের মা কলম চাঁন ও সন্দেহভাজন হিসেবে একই গ্রামের ইসমাইলকে আটক করে পুলিশ। ৯ দিন পর সিলেটের বিয়ানীবাজার এলাকা থেকে র‌্যাব গ্রেফতার করে বাবুলকে। পুলিশ তাদের জিজ্ঞেস করে। ধর্ষণের ঘটনা স্বীকার করলেও খুনের বিষয়ে বাবুলের কাছ থেকে কোনো তথ্য পায় না পুলিশ। পুলিশ তদন্তের পরিধি বাড়ায়। এ ঘটনায় অন্য কেউ জড়িত কি না, খোঁজ নিতে শুরু করে। পুলিশকে ভাবিয়ে তোলে। এক রাতে মামলার তদন্ত নাটকীয় মোড় নেয়। বিউটির নানির কাছ থেকে পুলিশ পেয়ে যায় নতুন তথ্য। বিউটির নানি পুলিশকে জানায়, ঘটনার আগের রাতে বিউটিকে বাড়ি থেকে নিয়ে যায় তার বাবা ছায়েদ এবং ময়না মিয়া। পুলিশ এমন তথ্য পেয়ে আটক করে বিউটির বাবা ছায়েদ ও ময়নাকে। ময়নাকে পুলিশ জেরা করলে সব তথ্য ফাঁস করে দেয়। সে পুলিশকে জানায়, ১০ হাজার টাকায় ভাড়াটে খুনি ভাড়া করে বিউটিকে খুন করা হয়েছে। বিউটির বাবাই খুন করার জন্য তাদের হাতে তুলে দেয় বিউটিকে। কেন নিজের সন্তানকে খুন করে আরেকজনকে ফাঁসানোর চেষ্টা করল ছায়েদ, পুলিশ খুঁজে তা বের করে।

পুলিশ জানতে পারে, বাবুলের মা কলম চাঁন বিগত ইউপি নির্বাচনে সংরক্ষিত মহিলা সদস্য নির্বাচিত হন। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ময়না মিয়ার স্ত্রী আসমা আক্তার। কিন্তু তিনি নির্বাচনে হেরে যান। কথা ছিল কলম চাঁন নির্বাচনে আসমার পক্ষ হয়ে কাজ করবেন। কিন্তু কথা না রেখে কলম চাঁন ভোটে দাঁড়িয়ে আসমাকে হারিয়ে দেন। এরপর উভয় পরিবারের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। তারপর থেকেই কলম চাঁনকে আটকাতে মরিয়া হয়ে ওঠেন ময়না মিয়া।

বাবুল মিয়া ছায়েদ আলীর মেয়েকে তুলে নিয়ে যাওয়ায় একটা সুযোগ হাতে পেয়ে যায়। ময়না মিয়া বিউটির বাবা ছায়েদ আলীকে নানা কুমতলব দেয়। ছায়েদকে বুঝায়, বিউটির আর বিয়ে হবে না। বিউটির কারণে তার অন্যান্য ছেলেমেয়েরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর চেয়ে বিউটিকে মেরে ফেলে তার মৃত্যুর দায়ভার মা কলম চাঁন ও তার ছেলে বাবুলের ঘাড়ে ফেলে দেওয়া যায়। কেউ সন্দেহ করবে না। এতে প্রলুব্ধ হয়ে ওঠেন বিউটির বাবা ছায়েদ আলী। তিনিও রাজি হয়ে যান। এরপরই বিউটিকে মেরে মা-ছেলেকে ফাঁসানোর ষড়যন্ত্র করে ময়না মিয়া।

সর্বশেষ খবর