শনিবার, ২২ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

লাশের গলায় গামছা

মির্জা মেহেদী তমাল

লাশের গলায় গামছা

২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর। রাজধানী ঢাকার খিলক্ষেত এলাকায় ফ্লাইওভারে ওঠার ডানপাশে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির লাশ পাওয়া যায়। লাশের গলায় ছিল গামছা বাঁধা। এর কদিন পর আক্তার হোসেন নামের এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীর লাশ মিলে কুড়িল ফ্লাইওভারের ওপর। তার গলায় পেঁচানো ছিল গামছা। আবারও খিলক্ষেত কুড়িল বিশ্বরোডসংলগ্ন ফ্লাইওভার থেকে মনির হোসেন নামের এক টেইলারিং মাস্টারের লাশ উদ্ধার করা হয়। তার গলায় ছিল গামছা বাঁধা। এ ঘটনার পর হাতিরঝিলসংলগ্ন ফ্লাইওভার থেকে মিজানুর রহমান নামের এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। মাত্র ২৫ দিনের ব্যবধান। এ সময়ের মধ্যে বিভিন্ন ফ্লাইওভারে পাওয়া যায় চারটি লাশ। প্রতিটি ক্ষেত্রে হত্যার ধরন একই রকম। সবার গলায় গামছা পেঁচানো। এমন খবরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে রাজধানীতে। রাতের আঁধারে ফ্লাইওভারগুলোতে মানুষ উঠতেও ভয় পেতে শুরু করে। একের পর এক ফ্লাইওভারে লাশ পাওয়ার ঘটনায় নড়েচড়ে বসে পুলিশ। কারা, কেন, কী কারণে তাদের হত্যা করেছে- সেই রহস্যের কিনারা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। অবশেষে প্রযুক্তিগত তদন্তের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী মিজান হত্যার ঘটনায় গ্রেফতার করা হয় নুরুল ইসলাম নামের একজনকে। পেশায় সিএনজি অটোরিকশার চালক হলেও দীর্ঘদিন ধরে সে পেশাদার ছিনতাইকারী চক্রের সক্রিয় সদস্য হিসেবে কাজ করে আসছিল। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মিজানের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া মোবাইল সেটটি উদ্ধার করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদ ও আদালতে নুরুলের দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বেরিয়ে এসেছে রোমহর্ষক তথ্য। কীভাবে পেশাদার একটি চক্র দিনের পর দিন ছিনতাই করতে গিয়ে হত্যার মতো ঘটনা ঘটিয়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল, তা জানতে পেরে বিস্মিত সংশ্লিষ্টরাও।

নুরুল জানায়, ঢাকা ও গাজীপুরে আটটি হত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল সে। নয় সদস্যের একটি গ্রুপ অনেক দিন থেকেই সিএনজি অটোরিকশায় যাত্রী তুলে তাদের জিম্মি করে সবকিছু হাতিয়ে নেয়। এতে কেউ বাধা দিলে তার গলায় গামছা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করে লাশ নির্জন এলাকায় ফেলে রাখে তারা। কোনো দেশীয়, এমনকি আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে না; গামছাই তাদের ‘অস্ত্র’। মিজানকে হত্যার সঙ্গে নুরুলও জড়িত ছিল। পুলিশের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, ৬ জানুয়ারি হাতিরঝিলসংলগ্ন ফ্লাইওভারে লাশ পাওয়ার পর এটিএম কার্ডের সূত্র ধরে মিজানের পরিচয় জানা যায়। তিনি এশিয়ান ইউনিভার্সিটির ছাত্র। বনানীর গোল্ডেন টিউলিপ নামে একটি ফোর স্টার মানের হোটেলে সিনিয়র ওয়েটার হিসেবে চাকরি করতেন। দুপুর ২টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত হোটেলে ডিউটি করে শেওড়া এলাকায় নিজের বাসার দিকে রওনা হন। সিএনজিতে ওঠার পর ছিনতাইকারীদের খপ্পরে পড়েন তিনি। অস্ত্র ঠেকিয়ে তার সঙ্গে থাকা মোবাইল ফোন, মানিব্যাগ ও ব্যাংকের এটিএম কার্ড নেওয়ার চেষ্টা করে ছিনতাইকারীরা। এতে বাধা দিলে ছিনতাইকারীরা গলায় গামছা  পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করে তাকে। এর পর লাশ ফ্লাইওভারে ফেলে চলে যায়। নুরুল পুলিশকে জানায়, সাত-আট মাস ধরে সে পেশাদার ছিনতাইকারী হিসেবে সক্রিয় রয়েছে। গাজীপুর, টঙ্গী, সাইনবোর্ড, আশুলিয়া, জিরাবো, উত্তরা, আবদুল্লাহপুর, খিলক্ষেত, বাড্ডা, মহাখালী, রামপুরা, তেজগাঁও, কারওয়ান বাজার, যাত্রাবাড়ী, ৩০০ ফিট এলাকা তাদের বিচরণক্ষেত্র। এই ছিনতাই চক্রের সদস্য নয়জন। তিনটি টিমে ভাগ হয়ে প্রতি রাতে তারা অপারেশনে বের হয়। একেকটি দল দিনে অন্তত দুজনকে টার্গেট করে। কোনো কোনো দিন চার-পাঁচজনও তাদের খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়েছে। নুরুল নিজেই প্রায় ৪০০ ছিনতাইয়ে জড়িত ছিল। এর মধ্যে আটজন তাদের হাতে নির্মম হত্যার শিকার হয়েছেন। এ ছাড়া ৩০-৪০ জনের কাছ থেকে সবকিছু হাতিয়ে নেওয়ার পর তাদের চলন্ত গাড়ি থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছে। ফ্লাইওভার ও আশপাশ এলাকায় সড়কবাতি না থাকা ও পুলিশি টহল কম থাকায় কাউকে হত্যার পর সেখানে লাশ ফেলা হয়।

জানা গেছে, নুরুলের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরে। ২০১১ সালের দিকে সে চট্টগ্রামে রিকশা চালাত। এরপর ঢাকায় এসেও কিছুদিন রিকশা চালিয়ে আবার চট্টগ্রামে ফিরে যায়। সেখানে গিয়ে সে একটি সিএনজি অটোরিকশা কেনে। তবে ওই রিকশার লাইসেন্স করতে না পারায় সেটি নিয়ে কুমিল্লায় চলে যায়। সেখানে কিছুদিন সিএনজি অটোরিকশা চালানোর পর তা বিক্রি করে দেয়। ওই টাকা দিয়ে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে ২০১৪ সালের দিকে ঢাকায় এসে ভাড়া নিয়ে সিএনজি অটোরিকশা চালানো শুরু করে। প্রায় সাত মাস আগে পেশাদার এক ছিনতাইকারীর সঙ্গে পরিচয় হয় নুরুলের। তার মাধ্যমে সে ছিনতাইকারী চক্রে নাম লেখায়। নুরুল জানায়, ছিনতাই করে দিনে ৫০০ থেকে ৯০ হাজার টাকা পর্যন্ত পেয়েছে সে। ছিনতাইয়ের পর যা পাওয়া যায়, তা দলের সদস্যের মধ্যে ভাগ হয়। নুরুলের দাবি, অসুস্থ স্ত্রীর চিকিৎসা ও ছেলের পড়াশোনার খরচ কুলাতে না পেরে বাড়তি আয়ের আশায় রাতে ছিনতাই করছিল সে।

পুলিশের উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তা জানান, চক্রটি ছিনতাই করা মোবাইল ফোনসেট জালাল নামের এক যুবকের কাছে জমা রাখত। সেও ছিনতাইকারী দলের সদস্য। ছিনতাইকৃত মোবাইল কয়েক মাস বন্ধ রাখার পর জালাল তা অন্যদের কাছে বিক্রি করত। নিহত মিজানের মোবাইল ফোনটি বাবু নামের একজনের কাছে বিক্রি করা হয়। নুরুলের পর জালাল ও বাবুকেও গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তারাও গতকাল আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি দিয়েছে। দুর্ধর্ষ ছিনতাই চক্রের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, ছিনতাইয়ে তারা বেশ কিছু কৌশল ব্যবহার করে। বেশিরভাগ সদস্য থাকে লুঙ্গি পরিহিত অবস্থায়। তাদের গলায় থাকে গামছা, হাতে বস্তা। পুলিশ কখনো জানতে চাইলে নিজেদের হকার হিসেবে পরিচয় দিয়ে বলে, কারওয়ান বাজার থেকে মালপত্র কিনতে যাচ্ছে। বিভিন্ন স্টেশন ও জনবহুল এলাকায় গিয়ে শেয়ারে সিএনজি অটোরিকশায় রাতে যাত্রীর ছদ্মবেশ ধারণ করে। ছিনতাইকারী চক্রের দুজন আগে থেকে বসে থাকে অটোরিকশার পেছনের সিটে। দলেরই একজন থাকে চালকের আসনে। টার্গেট করা যাত্রীকে তার গন্তব্য সম্পর্কে জানতে চায় ছদ্মবেশী চালক। তখন যাত্রী গন্তব্যে যেতে রাজি হলে হঠাৎ পেছনে বসা ছদ্মবেশী যাত্রীদের একজন অটোরিকশা থেকে নেমে পড়ে। ওই সময় সে জানায়- তার বমি বমি ভাব হচ্ছে। তাকে সাইডে বসতে হবে। এই কৌশলে টার্গেট করা ব্যক্তিকে পেছনে মাঝের আসনে বসানো হয়। সিএনজি অটোরিকশা চালু হলে ছিনতাইকারীদের একজন টার্গেট করা ব্যক্তির ঘাড়ের ওপর আঙুল অথবা ধাতব কোনো কিছু ধরে রেখে পিস্তলের নলের মতো ভাব করে বলতে শুরু করে- আমরা খারাপ লোক। তোর সঙ্গে যা আছে দ্রুত বের কর। অনেকেই জীবনের ভয়ে টাকা, মোবাইলসহ সবকিছু দিয়ে পার পায়। আর কেউ দিতে না চাইলে তাকে মারধর করা হয়। বেশি বাধা দিলে ছিনতাইকারীরা তাদের সঙ্গে থাকা গামছা দিয়ে গলায় পেঁচ মেরে হত্যা করে ফেলে। নুরুল পুলিশকে জানিয়েছে, একবার মাথায় টুকরিওয়ালা একজনকে হত্যা করা হয়েছিল। পরে পুলিশ খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, ওই টুকরিওয়ালা আসলে

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর