সোমবার, ২৪ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

সিন্ডিকেটের কবলে চা-চাষিদের ভাগ্য

পঞ্চগড়ে নিজেদের মতো করে চা-পাতার দাম নির্ধারণ করেন কারখানা মালিকরা বিক্রি হয় না সরকার নির্ধারিত মূল্যে, ন্যায্যমূল্য বঞ্চিত হাজার হাজার ক্ষুদ্র চাষি

মাহমুদ আজহার ও সরকার হায়দার, পঞ্চগড় থেকে

সিন্ডিকেটের কবলে চা-চাষিদের ভাগ্য

চা কারখানার একটি সিন্ডিকেটের কবলে পড়েছে পঞ্চগড়ের হাজার হাজার ক্ষুদ্র চা-চাষির ভাগ্য। দিনের পর দিন নিজেদের মতো করে কাঁচা চা-পাতার দাম নির্ধারণ করে কোটি কোটি টাকা মুনাফা করছেন কারখানা মালিকরা। প্রতি কেজি এক দিন ২২ টাকা ধরে নির্ধারণ করে আবার হুট করেই পরদিন ১৮-২০ টাকা চা-পাতার দাম নির্ধারণ করা হচ্ছে। এর সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যাখ্যাও তারা দেন না। অনেকটা নীলকরদের ভূমিকায় তারা ক্ষুদ্র চা-চাষিদের নানাভাবে নির্যাতন করেন। এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে স্থানীয় প্রভাবশালী একটি শ্রেণিও জড়িত। ওই প্রভাবশালীদের চা-পাতার দাম বছরজুড়েই ঊর্ধ্বমুখী থাকে। এ কারণে ক্ষুদ্র চা-চাষিরা দাম কম পেলেও এ নিয়ে তারা মুখ খোলেন না। বরং কারখানা থেকে তারা নিয়মিত মাসোহারা পান বলে অভিযোগ উঠেছে।

ক্ষুদ্র চা-চাষিদের অভিযোগ, পঞ্চগড়ে রাতারাতি ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা জেলার ১৮টি চা কারখানার মালিকরা গড়ে তুলেছেন এই সিন্ডিকেট। শক্তিশালী এই সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে পঞ্চগড়ের বিকাশমান চা-শিল্প। বর্তমানে নব্য নীলকরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন চা কারখানার মালিকরা। পঞ্চগড়ের মৈত্রী টি ইন্ডাস্ট্রিজ, মরগেন টি ইন্ডাস্ট্রিজ, করোতোয়া চা-কারখানা, গ্রিন কেয়ার টি কোম্পানি, টিটিসিএল, নর্থ বেঙ্গল চা কারখানা, বাংলা টি ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রিজ, ফাবিহা চা কারখানা, টিএমএমটি, স্যালিলেন চা কারখানাসহ ১৮টি চা কারখানার সমন্বয়ে গঠন করা হয়েছে বাংলাদেশ ব্রট লিফ ফ্যাক্টরি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন নামের একটি শক্তিশালী সংগঠন। এই সিন্ডিকেটের শিকারে পরিণত হয়েছেন পঞ্চগড় জেলার কয়েক হাজার ক্ষুদ্র চা-চাষি।

তেঁতুলিয়া উপজেলার শালবাহান এলাকার ক্ষুদ্র চা-চাষি মাসুদুল করিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘নির্দিষ্ট একটি মূল্যে চা-পাতা কেনে না কারখানা কর্তৃপক্ষ। কোনো দিন ২০ টাকা তো কোনো দিন ২২ টাকা। আমরা অনেকটা জিম্মি হয়ে পড়েছি তাদের কাছে। হঠাৎ করেই কেন ওঠানামা করছে দাম এর কোনো সঠিক উত্তরও দিতে পারছে না কারখানা কর্তৃপক্ষ।’

জানা যায়, মরগেন টি ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নিয়াজ আলী চিশতী এই সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি প্রতি সপ্তাহে অকশন মার্কেটে চায়ের দামের খবর নিয়ে কারখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সভা করে কাঁচা চা-পাতার মূল্য নির্ধারণ করেন। অবৈধভাবে চা-পাতার মূল্য নিয়ন্ত্রণ করায় চা-চাষিরা আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। চা-চাষিরা বলছেন, শ্রীমঙ্গলে ৩৫ টাকা কেজি দরে চা-পাতা কেনা হচ্ছে। অথচ পঞ্চগড়ে কখনো ২২ টাকা কখনো ২০ টাকা দরে চা-পাতা কেনা হয়। কখনো কখনো ১২ টাকা দরেও তাদের পাতা বিক্রি করতে হয়। এতে উৎপাদন খরচও ওঠে না। অথচ প্রভাবশালীদের কাছ থেকে সঠিক মূল্যেই চা-পাতা ক্রয় করেন তারা। যে বাগান মালিকদের রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে, তাদের চা-পাতার মূল্য কখনো কমে না।

জানা যায়, পঞ্চগড় জেলা প্রশাসক, চা বোর্ড, ক্ষুদ্র চাষি সমিতির প্রতিনিধি, কারখানার মালিক ও প্রতিনিধি সমন্বয়ে গঠিত কমিটি চা-পাতার মূল্য নির্ধারণ কমিটি রয়েছে। তবে চলতি মৌসুমে এখনো চায়ের মূল্য নির্ধারণ করেনি তারা। সর্বশেষ গত বছর চা-চাষিদের কাছ থেকে কাঁচা চা-পাতা প্রতি কেজি ২৪.৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু সেই দরে চা কিনছেন না কারখানা মালিকরা। মুনাফালোভী পঞ্চগড়ের চা কারখানার মালিকরা কৃষকদের কাছ থেকে মাত্র ১৬ থেকে ২০ টাকা দরে প্রতি কেজি বিক্রি করতে বাধ্য করছেন। এ ছাড়া পাতার মান খারাপ, ভেজা চা-পাতা, খারাপ মানের চা-পাতা ইত্যকার নানা অজুহাতে নির্ধারিত হারে চা-পাতার ওজনে পারসেন্টিস কেটে নিচ্ছেন তারা।

এ ব্যাপারে মরগেন টি ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নিয়াজ আলী চিশতী বলেন, পাতার মূল্য কম দেওয়া হচ্ছে না। পাতার মান খারাপ হলে দাম কম পাবে এটাই স্বাভাবিক। অনেকে পানি দিয়ে ভিজিয়ে চা-পাতা নিয়ে আসেন। অনেকে খারাপ পাতা দেন। তাদের দাম কম দেওয়া হয়। এ ছাড়া বর্তমানে ২০ থেকে ২৪ টাকা দরে চা-পাতা কেনা হচ্ছে। সিন্ডিকেটের বিষয়টি তিনি অস্বীকার করে বলেন, ‘এসব মিথ্যা কথা। এখানে কেউ কাউকে মানেন না। চিটাগাং অকশন মার্কেটে পঞ্চগড়ের চায়ের দাম কম হওয়ায় লোকসান এড়াতে অনেক সময় আমরা চা-চাষিদের সঠিক দাম দিতে পারি না। তাই আমরা চা-চাষিদের সরকার নির্ধারিত মূল্য দিতে পারছি না।

পঞ্চগড়ের বাংলাদেশ চা-বোর্ড আঞ্চলিক কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও নর্দান বাংলাদেশ প্রকল্পের পরিচালক ড. মোহাম্মদ শামীম আল মামুন বলেন, ২০২১-২২ সালের চা-পাতার ক্রয়মূল্য নির্ধারণ এখনো করা হয়নি। মাত্র দুটি অকশন হয়েছে। পাঁচ-ছয়টি অকশন হলে চা-পাতার ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করা হবে।

জানা যায়, কভিড পরিস্থিতিতেও এ বছর চা উৎপাদনে সর্বোচ্চ রেকর্ড হয়েছে। পঞ্চগড় আঞ্চলিক চা-বোর্ড কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালে পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, দিনাজপুর ও নীলফামারী (উত্তরবঙ্গের পাঁচ জেলায়) জেলার ১০টি নিবন্ধিত ও ১৭টি অনিবন্ধিত চা-বাগান, ৭ হাজার ৩১০টি ক্ষুদ্রায়তন চা-বাগানে (নিবন্ধিত ১ হাজার ৫১০টি) মোট ১০ লাখ ১৭ হাজার ৫৭ একর জমিতে চা-চাষ হয়েছে। এসব চা-বাগানগুলো থেকে ২০২০ সালে ৫ কোটি ১২ লাখ ৮৩ হাজার ৩৮৬ কেজি সবুজ চা-পাতা উত্তোলন করা হয়, যা থেকে পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁওয়ের ১৮টি চলমান চা কারখানায় ১ কোটি ৩ লাখ কেজি চা উৎপন্ন হয়েছে। বিগত সময়ের তুলনায় ২০২০ সালে ১ হাজার ৪৮৯ একর চা-আবাদি জমি বেড়েছে। আর চা উৎপাদন বেড়েছে ৭ দশমিক ১১ লাখ কেজি।

২০২০ সালে পঞ্চগড়সহ উত্তরবঙ্গের পাঁচ জেলায় সমতলের ১০টি চা-বাগান ও ৭ সহস্রাধিক ক্ষুদ্রায়তন চা-চাষির চা-বাগান থেকে ১ কোটি ৩ লাখ বা ১০ দশমিক ৩০ মিলিয়ন কেজি চা-উৎপাদিত হয়েছে। এ বছর চায়ের জাতীয় উৎপাদনের ৮৬.৩৯ মিলিয়ন কেজির মধ্যে উত্তরাঞ্চলের সমতলের চা-বাগান থেকে উত্তোলিত হয়েছে ১১ দশমিক ৯২ শতাংশ।

সর্বশেষ খবর