মঙ্গলবার, ২৫ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

উদ্বেগজনক অবস্থায় বাল্যবিয়ে

মহামারীতে বাল্যবিয়ে ১৩% বেড়েছে, পরিবারের আয় কম ও স্কুল বন্ধ অন্যতম কারণ

জিন্নাতুন নূর

উদ্বেগজনক অবস্থায় বাল্যবিয়ে

বাংলাদেশে বাল্যবিয়ে উদ্বেগজনক অবস্থায় পৌঁছেছে। গত ২৫ বছরের মধ্যে বাল্যবিয়ের হার এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে। বিভিন্ন গবেষণা ও জরিপ থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, মহামারীর সময়ে দেশে বাল্যবিয়ের হার ১৩% পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। করোনা সংক্রমণের পর গত দেড় বছরে অভিভাবকদের আয় কমে যাওয়া ও স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়াকেই বাল্যবিয়ে বৃদ্ধির অন্যতম কারণ বলে চিহ্নিত করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষজ্ঞরা জানান, দরিদ্র পরিবারের দৈনিক উপার্জন কমে যাওয়া, শহর থেকে অনেক পরিবারের গ্রামে স্থানান্তর হওয়া, অসচেতনতা, কন্যাসন্তানের ভরণপোষণ ও নিরাপত্তা দিতে না পারা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা, মহামারীতে কম খরচে এবং যৌতুক ছাড়া কন্যার বিয়ে দেওয়ার জন্য অভিভাবকরা সন্তানের বাল্যবিয়ে দিচ্ছেন।

বাংলাদেশ প্রতিদিনের জেলা প্রতিনিধিদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, মা-বাবারা অনেকটা নীরবে লুকিয়ে এবং রাতের আঁধারে এখন তাদের কিশোরী মেয়েটিকে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন। প্রশাসনের হস্তক্ষেপে কিছু বাল্যবিয়ে বন্ধ করা গেলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাল্যবিয়েই আটকানো যাচ্ছে না। আবার শহরের তুলনায় গ্রামেই বেশি বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে দেশের উপকূলীয় ও প্রত্যন্ত জেলা এবং উত্তরাঞ্চলে বাল্যবিয়ের ঘটনা বেশি ঘটছে।

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের এক জরিপে বলা হয়, করোনাকালে দেশে বাল্যবিয়ে হয়েছে ১৩ হাজার ৮৮৬টি। গত বছরের এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এই সাত মাসে দেশের ২১টি জেলার ৮৪ উপজেলায় ১৩ হাজার ৮৮৬টি বাল্যবিয়ে হয়েছে। এ সময় দিনে গড়ে ১ দশমিক ৭টি বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটেছে। জরিপ থেকে জানা যায়, যেসব মেয়ে বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে, তাদের মধ্যে শতকরা ৫০ দশমিক ৬ জনের বিয়ে হয়েছে ১৬ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে। শতকরা ৪৭ দশমিক ৭ জনের বিয়ে হয়েছে ১৩ থেকে ১৫ এর মধ্যে। শতকরা ১ দশমিক ৭ জনের বিয়ে হয়েছে ১০ থেকে ১২ বছর বয়সে। দেশে সবচেয়ে বেশি বাল্যবিয়ে হয়েছে বরগুনাতে ১৫১২টি, কুড়িগ্রামে ১২৭২টি, নীলফামারীতে ১২২২টি, লক্ষীপুরে ১০৪১টি এবং কুষ্টিয়াতে ৮৮৪টি। আর বাল্যবিয়ের উদ্যোগ যারা নিয়েছেন, তাদের মধ্যে শতকরা ৭৮ জনই ভুক্তভোগীর বাবা-মা। সংস্থাটির আরেক হিসাব বলছে, দেশের ৫৯% মেয়েকে ১৮ বছর বয়সের আগেই বিয়ে দেওয়া হয়, আর ২২% মেয়েকে তাদের ১৫তম জন্মদিনের আগে বিয়ে দেওয়া হয়।

উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি বিভাগ ২০২০ সালে সারা দেশের ১১টি জেলায় নারী ও কিশোর-কিশোরীদের ওপর কভিড-১৯ মহামারীর প্রভাব বিস্তারের ভিত্তিতে একটি জরিপ পরিচালনা করে। জরিপে দেখা যায়, মহামারীর কারণে দেশে বাল্যবিয়ের হার আগের চেয়ে ১৩% বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি গত ২৫ বছরে বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের সর্বোচ্চ হার। আবার দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের হার সবচেয়ে বেশি। বাল্যবিয়ের হার বেশি, বিশ্বের এরকম ১০টা দেশের তালিকায় আছে বাংলাদেশ। ইউনিসেফের সাম্প্রতিক এক রিপোর্ট বলছে, অনেক উন্নতির পরও বাংলাদেশ বাল্যবিয়েতে চতুর্থ স্থানে ছিল। করোনাভাইরাস লাখ লাখ কন্যাশিশুকে নতুন বাস্তবতার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। স্কুল বন্ধ, বন্ধু ও সাপোর্ট নেটওয়ার্ক থেকে বিচ্ছিন্নতা, ক্রমবর্ধমান অভাব এই মেয়েদের বিয়ের ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে।

সমাজসেবা অধিদফতরের আওতায় এবং ইউনিসেফের সহযোগিতায় চাইল্ড হেল্পলাইন ১০৯৮ সারা দেশে বিপদে পড়া শিশুদের সাহায্য করে থাকে। এই চাইল্ড হেল্পলাইনের প্রতিটি উপজেলায় মোবাইল টিম আছে। ইউনিয়ন পর্যায়েও সংস্থাটির কর্মীরা কাজ করছেন। এ ছাড়া সরকারি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এই হেল্পলাইনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বাল্যবিয়ে রোধে কাজ করছে। হেল্পলাইনটির ব্যবস্থাপক চৌধুরী মো. মোহাইমেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, করোনাকালে সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাপে গ্রাম ও শহরে অনেক কিশোরী অসচ্ছল পরিবারগুলোর কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। চাকরি হারিয়ে অনেক পরিবারের অভিভাবকরা পরিবারের একজন সদস্য কমাতে বাল্যবিয়ে দিচ্ছেন। এর বাইরে এই বিষয়ে সাধারণের মধ্যে এখনো সচেতনতার অভাব আছে। মোবাইল ফোনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপরিচিতদের সঙ্গে কথোপকথন থেকে প্রেমের সম্পর্ক গড়েও অনেকে কম বয়সে বিয়ে করছে। অর্থাৎ সবকিছুই বাল্যবিয়ে বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। এ পরিস্থিতি অবশ্যই আমাদের জন্য উদ্বেগজনক। তিনি আরও বলেন, বাল্যবিয়ে থামাতে সরকারি পর্যায়ে বেশকিছু নীতিমালা থাকলেও গ্রামীণ পর্যায়ে এখনো এ বিষয়টি সেভাবে সচেতনতা তৈরি করতে পারেনি। অনেক সময় দেখা যায়, ১৬ থেকে ১৭ বছর বয়সে যে বিয়েগুলো হচ্ছে সেখানে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও যুক্ত হয়ে সেই বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সারতে সাহায্য করছেন।

সর্বশেষ খবর