বৃহস্পতিবার, ২৭ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

অনলাইন বাণিজ্যের নামে প্রতারণা

ক্রেতা প্রতারিত, সময়মতো সঠিক পণ্য মিলছে না, ভোক্তা অধিকার আইনে দ্রুত বিচার দাবি, গোয়েন্দা নজরদারি চায় ই-ক্যাব

রুহুল আমিন রাসেল

অনলাইন বাণিজ্যের নামে প্রতারণা

অনলাইনে কেনাকাটা বা ই-কমার্সের নামে চলছে ভয়াবহ প্রতারণা। পুলিশের তথ্য- এবার ঈদের কয়েকদিন আগে ফেসবুকে ‘ললনা ফ্যাশন’ নামের পেজ থেকে দুটি শাড়ি অর্ডার দেন সালমা আক্তার আইভী। পরিশোধ করেন অগ্রিম মূল্য। পরে পণ্য হাতে পেয়ে দেখেন অর্ডার দেওয়া শাড়ি নয়, পেয়েছেন নিম্নমানের শাড়ি। একই অভিজ্ঞতা পেশায় চিকিৎসক মিতু বসাকেরও। তিনি ৪ হাজার টাকার শাড়ির বদলে পেয়েছেন ৪০০ টাকা দামের শাড়ি। অনলাইনে কেনাকাটায় প্রতারণার এমন তথ্য আরও মিলেছে। অনলাইন উদ্যোক্তাদের সংগঠন ই-ক্যাবও বলছে- ক্রেতারা প্রতারিত হচ্ছেন। সময়মতো ও সঠিক পণ্য ক্রেতারা পাচ্ছেন না। এই প্রতারণা বন্ধে প্রয়োজন ভোক্তা অধিকার আইনে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা। জানা গেছে, অনলাইনের মাধ্যমে সাশ্রয়ী দামে গ্রাহক পর্যায়ে সরাসরি পণ্য পৌঁছে দিতে দেশে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে ই-কমার্স ব্যবসা। এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে কিছু কিছু চক্র ভুয়া অনলাইন পেজ খুলে গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে, লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এই দুষ্ট চক্রের সদস্যরা ক্রেতাদের সঙ্গে চাতুর্যপূণ প্রতারণা করছে। অনলাইনে ক্রেতাদের কাছ থেকে পণ্য সরবরাহে প্রি- অর্ডারের নামে অগ্রিম টাকা নিয়ে করছে প্রতারণা। আবার অর্ডার নিয়ে সঠিক পণ্যের বদলে দিচ্ছে মানহীন কম-দামি পণ্য। দুই দিনে পণ্য সরবরাহের কথা বলে ১২ দিনেও ডেলিভারি দেওয়া হয় না। এ প্রসঙ্গে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বা ই-ক্যাব সভাপতি শমী কায়সার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অনলাইন কেনাকাটায় প্রতারণা বন্ধে কঠোর গোয়েন্দা নজরদারি ও ই-কমার্স আইন চাই। কারণ, এটা বড় মার্কেট। চ্যালেঞ্জটা হলো- কিছুটা প্রতারণা হচ্ছে। কিছু প্রতিষ্ঠান নিয়ে অভিযোগ আছে। সময়মতো ও সঠিক পণ্য ক্রেতারা পাচ্ছেন না। তবে এই খাতের জন্য আমরা একটি স্টান্ডার্ড অপারেটিং প্রোসিডিউর বা এসওপি তৈরি করছি। এতে এই খাতের মান বজায় থাকবে বলে আশা করছি। উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম বা উই সভাপতি নাসিমা আক্তার নিশা গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ই-কমার্সের প্রতারণা এখন বড় বড় মার্কেট প্লেসগুলোতে বেশি হচ্ছে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে প্রতারিত হওয়ার হার কম। এই প্রতারণা বন্ধে ভোক্তা অধিকার আইনের প্রয়োগ বাড়াতে হবে। দ্রুত বিচার করতে হবে। তার মতে যারা ই-কমার্সের নামে প্রতারণা করছে, তাদের বিরুদ্ধে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে। জনস্বার্থ চিন্তা করতে হবে। ক্রেতাদের যেন কোনো ক্ষতি না হয়। কারণ, ই-কমার্স খাত অনেক বড় হয়েছে। কিছু প্রতিষ্ঠানের কারণে পুরো ই-কমার্স ব্যবসার ক্ষতি করা যাবে না।

এদিকে অনলাইন ব্যবসায় বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়ে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার তথ্য পেয়েছে  পুলিশ। সূত্র বলছে- বিশ্বের নামকরা ই-কমার্স ভিত্তিক বিভিন্ন মার্কেট প্লেসে বিনিয়োগের নামে চলছে প্রতারণা। ডোমেইন ক্রয়, ওয়েবসাইট তৈরির নামে প্রযুক্তিতে দক্ষ এক শ্রেণির প্রতারক হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি টাকা। সম্প্রতি চক্রের মূল হোতাসহ তিনজনকে গ্রেফতারের পর পুলিশ বলছে, অধিক মুনাফার লোভ দেখিয়ে চক্রটি সাধারণ মানুষকে ফাঁদে ফেলত।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে একটি ট্যুরে গিয়ে জাকারিয়া পারভেজ নামে একজনের সঙ্গে পরিচয় হয় জোবায়ের হোসেন নামের এক ব্যক্তির। পরবর্তী সময়ে তারা একসঙ্গে একাধিক ট্যুরে অংশ নেন। একপর্যায়ে জাকারিয়া তাকে ই-কমার্স মার্কেট প্লেস অ্যামাজন এফিলিয়েটে বিনিয়োগের প্রস্তাব দেন। বিপুল মুনাফার আশ্বাসে ৩ লাখ টাকা বিনিয়োগ করার পর শুরু হয় টালবাহানা। একই ঘটনা ঘটে আরেক ব্যক্তির সঙ্গেও। তার কাছ থেকে নেওয়া হয় ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা। অধিক মুনাফার লোভ দেখিয়ে এক চিকিৎসকের কাছ থেকে পারভেজ হাতিয়ে নিয়েছে ৩৩ লাখ টাকা। পরে ভুক্তভোগী ওই চিকিৎসকের করা মামলায় অবশেষে গোয়েন্দা জালে ধরা পড়েছে প্রতারক জাকারিয়া ও তার দুই সহযোগী। জাকারিয়া এবং তার সহযোগীরা মূলত বিভিন্ন ইভেন্টভিত্তিক ট্যুরে গিয়ে টার্গেট নির্ধারণ করত। অ্যামাজনের মতো বড় মার্কেট প্লেসে বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়ে ডোমেইন কেনার নামে শুরু হতো তাদের প্রতারণার প্রথম ধাপ। পরে ওয়েবসাইট তৈরি, র‌্যাংকিং, হোস্টিং, গুগল আপডেটের নাম দিয়ে হাতিয়ে নিত বিপুল পরিমাণ অর্থ। এ সংক্রান্ত ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে হওয়া একটি মামলা তদন্ত করতে গিয়ে গোয়েন্দা পুলিশ সন্ধান পায় ওই চক্রটির।

এ প্রসঙ্গে ডিবি সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) মহিদুল ইসলাম গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আটকরা নতুন করে পেজ খুলে এবং বুস্টিং করে কিছু ক্রেতা জোগাড় করে এবং প্রতারণা করার পর পেজটি বন্ধ করে দেয়। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের অফিশিয়াল পেজ থেকে আসল পণ্যের ছবি ডাউনলোড করার পর দাম পরিবর্তন করে তারা নিজেদের তৈরি করা পেজে বিজ্ঞাপন দিত। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আগ্রহী ক্রেতাদের কাছ থেকে নেওয়া হতো অগ্রিম ডেলিভারি চার্জ। পরে নিম্নমানের পণ্য প্যাকিং করে নির্দিষ্ট কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে অফেরতযোগ্য শর্তে পাঠিয়ে দেওয়া হতো।

জানা গেছে, প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের পাশাপাশি ফেসবুকে কয়েক লাখ নারী উদ্যোক্তার অংশগ্রহণে ই-কমার্সে দেশীয় পণ্যের শক্তভিত্তি গড়ে উঠেছে। হাতে তৈরি বা প্রান্তিক পর্যায় থেকে আনা পণ্য দিন-রাত অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে। ফলে বাংলাদেশে ই-কমার্সের বাজার দেড় বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। যা চলতি বছর দুই বিলিয়ন এবং ২০২৩ সালে তিন বিলিয়ন ডলার ছাড়ানোর তথ্য দিয়েছে জার্মান ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্ট্যাটিস্টা।

জানা গেছে, এখন বাড়ছে অনলাইনের প্রচার ও প্রসার। শপিংমল বা রেস্তোরাঁর বদলে মানুষ এখন ঘরে বসেই অনলাইনে অর্ডার করছেন পছন্দের পণ্য। ওষুধ, পোশাক, খাদ্যদ্রব্যসহ সব ধরনের পণ্য কেনাকাটা করছেন অনলাইন প্লাটফরম থেকে। দরিদ্র কিংবা নিম্ন মধ্যবিত্তরা বাজারমুখী হলেও মধ্যবিত্ত কিংবা উচ্চবিত্তরা অনলাইনে কেনাকাটা করছেন বেশি। বিক্রি বাড়ায় খুশি ব্যবসায়ীরা। সন্তুষ্ট ক্রেতারাও। ব্যবসার পরিধি বাড়ানো ও ক্রেতা ধরে রাখতে ব্যবসায়ীরা নিত্য নতুন ছাড় দিচ্ছেন। অনলাইনে পোশাক, গহনা, খাবার, ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী, কসমেটিক্স, সবজিসহ সব কিছুই মিলছে। ফলে প্রচলিত বিক্রয় ব্যবস্থার পাশাপাশি অনলাইনের মাধ্যমে সাশ্রয়ী দামে গ্রাহক পর্যায়ে সরাসরি পণ্য পৌঁছে দিতে দেশে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে ই-কমার্স ব্যবসা।

ই-ক্যাব সূত্র জানায়, বাংলাদেশে ই-কমার্স বাড়ছে খুবই দ্রুত। গত তিন বছর ধরে এই খাতের প্রবৃদ্ধি প্রায় একশো ভাগ। অর্থাৎ প্রতি বছর প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে এই খাত। বাংলাদেশে এই মুহুর্তে প্রায় ১২০০-এর মতো প্রতিষ্ঠান ই-কমার্সের সঙ্গে যুক্ত। সব ধরনের পণ্যই এখন বাংলাদেশে অনলাইনে কেনাবেচা হয়। তবে উন্নত দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের ই-কমার্স এখনো একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে। অনলাইনে অর্ডার দেওয়া গেলেও এখনো নগদ অর্থেই লেনদেন বেশি। এটাকে বলা হয় ক্যাশ অন ডেলিভারি। অর্ডার অনলাইনে দেওয়া হলেও কল সেন্টার থেকে ফোন করে সেটি আবার নিশ্চিত করা হয়। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান পণ্য কাস্টমারের কাছে পৌঁছে দিয়ে নগদ টাকায় নিয়ে আসে।

সর্বশেষ খবর