বৃহস্পতিবার, ২৭ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

বৃদ্ধা মায়ের খুনি ছেলে

মির্জা মেহেদী তমাল

বৃদ্ধা মায়ের খুনি ছেলে

বাথরুমে পড়ে আছেন ৮০ বছরের বৃদ্ধা শরিফুন্নেসা। জবাই হয়েছেন। রক্তে ভেসে যাচ্ছে। ঘরের মালামাল লন্ডভন্ড। পুলিশ আসে। লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করছে তারা। গোয়েন্দারাও ফ্ল্যাটের আনাচে-কানাচে নজর দিচ্ছেন। খুনের কোনো সূত্র খুঁজে পাওয়া যায় কি না। বৃদ্ধার সন্তান ও স্বজনরা ছুটে এসেছেন। মায়ের মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছেন ছেলে রফিকুল ইসলাম বাবু। তার আহাজারিতে অনেকেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। ২০১৬ সালের ১৬ নভেম্বর রাজধানীর পল্লবীর একটি ছয়তলা ভবনের নিজ ফ্ল্যাটে খুন হন শরিফুন্নেসা। পুলিশ তদন্ত করতে গিয়ে কিছুই খুঁজে পায় না। পুলিশের মাথায় ঢুকছে না, অসুস্থ মৃত্যুপথযাত্রী এই বৃদ্ধাকে এভাবে নৃশংসভাবে কেন হত্যা করা হবে? এর পেছনে কী এমন ঘটনা থাকতে পারে যে, খুনিরা বাসায় এসে খুন করে নির্বিঘ্নে পালিয়ে যেতে পারে! পুলিশ ঘটনার রাতে পরিবারের কারও সঙ্গেই কথা বলতে পারেনি। আশপাশে লোকজনের সঙ্গে কথা বলেও কোনো কূলকিনারা পাচ্ছেন না। শরিফুন্নেসার তিন ছেলের মধ্যে দুই ছেলে থাকেন বিদেশে। তার কাছে এক ছেলে রফিকুল ইসলাম থাকতেন পরিবার নিয়ে। শরিফুন্নেসার দুই মেয়ের মধ্যে একজন ছিলেন ভারতে। এ ঘটনায় রফিকুল ইসলাম থানায় বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলায় কাউকে আসামি করা হয়নি। সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও খুনের কোনো সূত্র খুঁজে না পাওয়ায় পুলিশ নিজেই একটু হতাশ। তদন্ত কর্মকর্তা হঠাৎ খেয়াল করেন, বৃদ্ধার ছেলে রফিকুল ইসলামের সম্বন্ধি জাহিদ আসলামকে কদিন ধরে দেখা যাচ্ছে না। খুনের পর তাকে খুব তৎপর দেখা যাচ্ছিল। সেই জাহিদের দেখা না পাওয়ায় বিষয়টা খটকা লাগে। কর্মকর্তা গোপনে গোপনে তার খোঁজ করতে থাকেন। ৯ দিনের মাথায় সোর্সের মাধ্যমে জাহিদের অবস্থান জানতে পারে পুলিশ। ‘জাহিদ সাহেব, আপনি কোথায়? একটু দরকার ছিল কেসটার ব্যাপারে। একটু থানায় আসেন। ফোনে জাহিদকে জানান পুলিশ কর্মকর্তা। ব্যস্ততার কথা বললেও শেষমেশ থানায় আসার বিষয়ে রাজি হন জাহিদ। থানায় জাহিদকে পেয়ে পুলিশ তাকে বিভিন্ন বিষয়ে জেরা করতে থাকে। একপর্যায়ে তদন্ত কর্মকর্তার সরাসরি প্রশ্ন, কেন খুন করলেন এমন একজন বৃদ্ধা মহিলাকে? ভ্যাবাচ্যাকা খান জাহিদ। বলেন, আমি কেন খুন করতে যাব? পুলিশ তার চোখমুখ খেয়াল করে। কেমন যেন অপরিচিত মনে হচ্ছে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে। তিনি ভাবছেন, মনে হয় ঘটনার রহস্য উদঘাটন হতে যাচ্ছে। আমার কাছে তথ্য-প্রমাণ রয়েছে। তাই আপনাকে প্রশ্ন করলাম। সোজাসাপটা প্রশ্নের সোজাসাপটা জবাব দেন। নইলে কপালে আপনার খারাবি আছে। ভয় পান জাহিদ। তিনি নিশ্চিত পুলিশ সব জেনে ফেলেছে। জাহিদ মুখ খোলেন। ফাঁস করেন খুনের নেপথ্য কাহিনি। ঘটনা শুনে পুলিশ হতবাক। স্থির হয়ে বসে থাকে কিছুক্ষণ। ভাবে, এটা কীভাবে সম্ভব! এরপর পুলিশ খুনের পরবর্তী দিনগুলোতে প্রত্যেকের ভূমিকা, আচরণ মনে করার চেষ্টা করে। জাহিদের কাছে পাওয়া তথ্যগুলো মিলে যাচ্ছে। পুলিশ ধীরে ধীরে বিশ্বাস করতে শুরু করে। ব্যাপক জেরার মুখে সব ফাঁস করে দেন। ধরা পড়েন আসল খুনি। এই খুনি আর কেউ নন,  যিনি খুনের পর লাশ ধরে আহাজারি করছিলেন, বলছিলেন-ওমা, তোমার এই কাজটা কে করল? মা আমি কারে নিয়ে থাকুম। তিনি হলেন, বৃদ্ধার ছেলে রফিকুল ইসলাম। আর তার সঙ্গে ছিলেন সম্বন্ধি জাহিদ আসলাম এবং বন্ধু শওকত। জাহিদ পুলিশকে জানান, রফিকুলের নির্দেশে তার বৃদ্ধা মাকে হত্যা করা হয়েছে। স্ত্রীর চিকিৎসার খরচের জন্য নিজ মাকে জবাই করে হত্যা করেন রফিকুল। পুলিশ রফিকুল ও তার বন্ধু শওকতকে গ্রেফতার করে। ঘটনার সময় রফিকুলের স্ত্রী ছিলেন হাসপাতালে। হাসপাতালে স্ত্রীর সেবা-যত্নের পর বাসায় ফিরেই মাকে জবাই করেন। স্ত্রীর প্রতি বিকৃত ভালোবাসার কাছে জন্মদাত্রী মমতাময়ী মাতৃত্বের করুণ পরাজয় ঘটে। তদন্তসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খুনের পর অপরাধ ঢাকতে বাবু নানা নাটকীয়তার আশ্রয় নেন। প্রথমে নিজে বাদী হয়ে পল্লবী থানায় দুই আইনজীবী পাঠিয়ে মামলা করেন। কিন্তু সন্দেহভাজন নেই উল্লেখ করেন। আবার তদন্ত ও রহস্য উদঘাটনে অনীহা দেখায়। খুনের পর থেকে অসুস্থতার ভান করে নানা কৌশলে এড়িয়ে যাচ্ছিলেন মায়ের দাফন-কাফন ও মামলায় নিজের দায়িত্ব ও আনুষ্ঠানিকতা। পুলিশ জানায়, স্ত্রীর চিকিৎসার খরচ ও ঋণের টাকার জন্য অপর দুই সহযোগী নিয়ে নিজের বৃদ্ধা মাকে খুন করেন রফিকুল। ঘটনার দিন ১৬ নভেম্বর দুপুরে বাবু বাসা থেকে হাসপাতালে যায়। তখন রাস্তায় দেখা হয় জাহিদের সঙ্গে। তখন রফিকুল বলে রাত ১১টায় বাসায় দেখা করবি। কাজ আছে। এরপর সে স্ত্রীর কাছে হাসপাতালে চলে যায়। সেখানে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত ছিল। স্ত্রীর জন্য ওষুধপথ্য কিনে দেয়। সেবা-যত্ন করে। এরপর হাসপাতাল থেকে রফিকুল বাসার দিকে যায়। বাসায় ওঠার সময় নিচতলার ভাড়াটিয়া ছোটবেলার বন্ধু শওকতসহ রফিকুল তৃতীয়তলায় ওঠে। কথামতো রাত সাড়ে ১১টায় একই বাসায় ওঠেন জাহিদ। তারপরই রফিকুল বৃদ্ধা মা শরিফুন্নেসাকে জোরে গলা ধাক্কা দেন। এতে তিনি ছিটকে গিয়ে বাথরুমের দেয়ালে আছড়ে পড়ে মেঝেতে পড়ে যান। অচেতন হয়ে পড়েন। তারপর রফিকুল বলেন ‘খালাস করেন। পা ধরেন।’ পরে জাহিদকে ধমক দিয়ে বলে, ‘পা ধর’। তখন জাহিদ দুই পা চেপে ধরে। শওকত গলায় ছুরির পোঁচ দিয়ে গলা কাটে। এরপর ছুরি রফিকুল নিয়ে নেয়। একটি আলমারির পেছনে ফেলে রাখে। তারপর বলে এখন আপনারা ‘সেইফ হন। চলে যান।’ তারপর জাহিদ আগে কক্ষ থেকে বের হয়। এরপর বের হয় শওকত। হত্যাকান্ডের বেশ কিছুক্ষণ পর রাত ১২টার দিকে রফিকুল ওই ঘরে ‘আমার মাকে কারা খুন করেছে’ বলে কেঁদে ওঠেন। লোকজনকে শুনানোর উদ্দেশে বিলাপ জুড়ে দেন। তা শুনে আশপাশের লোকজন ওই বাসায় ভিড় জমান। পুলিশ এসে রাতেই লাশ উদ্ধার করে। তখন রক্ত কিছুটা জমাট বেঁধে যায় বলে জানান মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। শরিফুন্নেসার স্বামী মুক্তিযোদ্ধা ও সেনাবাহিনীর সাবেক হাবিলদার মহব্বত আলী ২৫ বছর আগে ১৯৯১ সালে মারা যান। তার ৩ ছেলে ও ২ মেয়ে। রাজধানীতে তাদের বেশ কিছু জায়গা-সম্পত্তি ছিল। অনেক আগেই তা ভাগ হয়ে গেছে। আর বৃদ্ধা মা শরিফুন্নেসা থাকতেন দেশে থাকা ছেলে রফিকুলের কাছে। ওই বাসায় ফ্ল্যাটে রফিকুল ও তার মা থাকতেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর