শুক্রবার, ২৮ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

টিকায় রোগ প্রতিরোধ কয়েক বছর : গবেষণা

প্রতিদিন ডেস্ক

করোনাভাইরাসের টিকা নেওয়ার পর অন্তত এক বছর দেহে এর বিরুদ্ধে সুরক্ষা বজায় থাকে, সম্ভবত তা আমৃত্যুও হতে পারে। নতুন দুটি গবেষণার ফলাফল এমন তথ্যই জানাচ্ছে। সূত্র : নিউইয়র্ক টাইমস। দুটি গবেষণাতেই দেখা গেছে, কভিড-১৯ থেকে সেরে ওঠার পরে এক ডোজ টিকা নিয়েছেন এমন বেশির ভাগ মানুষেরই বুস্টার ডোজ নেওয়ার দরকার হবে না। টিকা গ্রহণকারীদের মধ্যে যারা করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হননি তাদের ক্ষেত্রে হয়তো দ্বিতীয় ডোজ নিতে হতে পারে। গবেষণার ফল থেকে এটাও দেখা গেছে যে, একটি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী আবারও সংক্রমিত হতে পারেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পরেও যাদের দেহে প্রতিরোধ সক্ষমতা গড়ে ওঠেনি। গত সোমবার বিজ্ঞান বিষয়ক সাময়িকী ন্যাচার এ প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, উভয় গবেষণা প্রতিবেদনেই ওইসব মানুষের ওপর পরীক্ষা চালানো হয়েছে যারা এক বছর আগে করোনাভাইরাসের সংস্পর্শে এসেছিলেন। এই ভাইরাসকে চিনে নেওয়া কোষগুলো অস্থিমজ্জায় থাকে এবং যখন দরকার তখন অ্যান্টিবডি সৃষ্টি করতে পারে। অন্য গবেষণাটিতে দেখা গেছে, দেহে প্রাথমিক সংক্রমণের পর ‘মেমোরি বি’ নামের কোষগুলো করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে অন্তত ১২ মাস পর্যন্ত পরিপক্ব ও শক্তিশালী হতে থাকে।

 ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভেনিয়ার ইমিউনোলজিস্ট স্কট হেনসলে বলেন, ‘সার্স-কোভ-২-এর সংক্রমণে অথবা টিকা নেওয়ার কারণে এর বিরুদ্ধে দেহে যে প্রতিরোধ সক্ষমতা গড়ে ওঠে তা দীর্ঘস্থায়ী হয়- সাম্প্রতিক গবেষণাগুলোর এমন ফলাফলের সঙ্গে এই গবেষণাগুলোর ফলাফলও সঙ্গতিপূর্ণ।’ এই দুটি গবেষণাই সম্ভবত করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সক্ষমতা গড়ে ওঠা নিয়ে যে ভীতি তা দূর করতে সহায়ক হবে। একটি আশঙ্কা রয়েছে, করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে মানবদেহের প্রতিরোধ ক্ষমতা সাময়িক হতে পারে, যেমনটি হয়ে থাকে সাধারণ সর্দি-জ্বরের ভাইরাসের ক্ষেত্রে। তবে ওইসব ভাইরাস কয়েক বছরের ব্যবধানে উল্লেখযোগ্যভাবে নিয়মিত বদলাতে থাকে, জানান হেনসলে। তিনি বলেন, ‘আমরা বারবার সাধারণ করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হই কারণ প্রতিরোধ সক্ষমতা নয় বরং আমাদের জীবনকালজুড়ে এসব ভাইরাস বিবর্তিত হতে থাকে।’

 

মানবদেহে কোষের স্মৃতির পরিপক্বতার ওপর পরিচালিত গবেষণা দলের প্রধান রকফেলার ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কের ইমিউনোলজিস্ট মাইকেল নুজেনসাইগ জানান, সার্স-কোভ-২ এর সংক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় দেহে যে ‘মেমরি বি’ কোষ সৃষ্টি হয় এবং টিকার মাধ্যমে আরও শক্তিশালী হয় সেগুলো এমনকি ওই ভাইরাসের অন্যান্য ধরনের বিরুদ্ধেও সক্রিয় থাকে এবং দেহে বুস্টার ডোজের চাহিদাও থাকে না। তিনি আরও বলেন, ‘যেসব মানুষ করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন অথবা এর টিকা গ্রহণ করেছেন, তাদের প্রতিক্রিয়া খুবই ভালো, খুবই চমৎকার অ্যান্টিবডি সেট দেহে গড়ে উঠেছে, কারণ তাদের অ্যান্টিবডিরও বিবর্তন হচ্ছে। আমি আশা করছি যে এগুলো দীর্ঘ সময় থাকবে।’

প্রথমবার করোনাভাইরাসের সংস্পর্শে আসার পর, বি কোষগুলো দ্রুত বিকশিত হয় এবং বড় আকারে অ্যান্টিবডি তৈরি করে। একবার সংক্রমণ প্রশমিত করে ফেলার পর, স্বল্প সংখ্যক কোষ অস্থি মজ্জায় অবস্থান নেয়, ধারাবাহিকভাবে অ্যান্টিবডি উৎপন্ন করে চলে।

সুনির্দিষ্টভাবে নতুন করোনাভাইরাস সংশ্লিষ্ট মেমরি বি কোষ নিয়ে যারা গবেষণা করেছেন সেই দলের প্রধান সেইন্ট লুইজের ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির আলি এলেবেদি ৭৭ জন করোনাভাইরাস সংক্রমিতের রক্ত পরীক্ষা করেন তিন মাসের অন্তর্বর্তী বিরতি দিয়ে। তিনি রক্তের প্রথম নমুনা সংগ্রহ শুরু করেন রোগীরা কভিড-১৯ আক্রান্ত হওয়ার এক মাস পর। ওই ৭৭ জনের মধ্যে মাত্র ৬ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল, বাকিদের দেহে সামান্য উপসর্গ দেখা গেছে। সংক্রমিত হওয়ার চার মাস পর ওই ৭৭ জনের দেহে অ্যান্টিবডির মাত্রা দ্রুত কমে যায় এবং পরের মাসগুলোতে তা ধীরে ধীরে নামতে থাকে- এই ফলাফল অন্য গবেষণাটির ফলাফলের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।

কিছু বিজ্ঞানী অ্যান্টিবডির এই হ্রাসকে প্রতিরোধ সক্ষমতা দুর্বল হয়ে যাওয়া হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, তবে এটাই স্বাভাবিকভাবে প্রত্যাশিত বলে মত দিয়েছেন অন্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, যদি সংক্রমিত হওয়ার পরপর প্রতিটি প্যাথোজেনের বিরুদ্ধে রক্তে নিঃসরিত উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবডি বজায় থাকত, তাহলে এটা দ্রুত একটি ঘন তরলে রূপান্তরিত হতো। বরং, সংক্রমণের ঝুঁকি কমিয়ে দেওয়ার পর রক্তে অ্যান্টিবডির মাত্রা দ্রুত হ্রাস পায়, একই সময়ে মেমরি বি কোষ অস্থিমজ্জায় সুপ্ত অবস্থায় অবস্থান করতে থাকে, যখন দরকার তখন ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য। এলেবেদির দল ১৯ জনের অস্থিমজ্জা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে তাদের দেহে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের সাত মাস পরে। এদের ১৫ জনের দেহে শনাক্তযোগ্য ‘মেমরি বি’ কোষ পাওয়া গেলেও চারজনের দেহে তা পাওয়া যায়নি। এর থেকে তারা ধারণা করছেন, কিছু মানুষের দেহে খুবই স্বল্পমাত্রায় এই কোষ থাকে অথবা কারও কারও দেহে থাকেই না।

এলেবেদি বলেন, ‘এটা থেকে আমি বলতে পারি যে আপনি করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হলেও, আপনি যে এর বিরুদ্ধে দারুণ প্রতিরোধ সক্ষমতা অর্জন করবেন তা হয়তো হবে না। গবেষণার ফলাফল এই ধারণাটিকেই মজবুত করেছে যে যারা কভিড-১৯ থেকে সেরে উঠেছেন তাদেরও টিকা নেওয়া উচিত।

নুসেনজাইগের দল তাদের গবেষণায় দেখেছেন কীভাবে ‘মেমরি বি’ কোষ সময়ে সঙ্গে সঙ্গে পরিপক্ব হয়। গবেষকরা ৬৩ জনের রক্ত বিশ্লেষণ করেন যারা এক বছর আগে কভিড-১৯ থেকে সেরে উঠেছেন। অংশগ্রহণকারীদের বড় অংশের দেহেই সামান্য উপসর্গ দেখা গিয়েছিল এবং ২৬ জন মডার্না বা ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা নিয়েছেন।

গবেষক দলটি দেখেছে, ওই ৬৩ জনের দেহে আবারও সংক্রমিত হওয়া থেকে সুরক্ষাদানকারী সক্রিয় অ্যান্টিবডি ছয় থেকে ১২ মাসের মধ্যে অপরিবর্তিত ছিল, এ ছাড়া ওই অ্যান্টিবডি সংশ্লিষ্ট বা কম গুরুত্বপূর্ণ অ্যান্টিবডিগুলো ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়েছে।

‘মেমরি বি’ কোষ বিবর্তিত হতে থাকায়, তারা যে অ্যান্টিবডি তৈরি করে সেগুলো এমনকী আরও বিস্তৃত পরিসরের করোনাভাইরাসের ধরনের মোকাবিলা করতে সক্ষম। এই ধারাবাহিক পরিপক্বতা অর্জিত হয় সম্ভবত দেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থার হাতে আটক থাকা ছোট আকারের ভাইরাসের ওপর টার্গেট প্র্যাকটিসের মাধ্যমে।

করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার এক বছর পরে অংশগ্রহণকারীদের দেহে, যারা টিকা নেননি, ভাইরাসটির অন্যান্য ধরনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ কার্যক্রম কমে আসে, বেশি দুর্বলতা দেখা গেছে সাউথ আফ্রিকায় শনাক্ত হওয়া ধরনটির বিরুদ্ধে।

অন্যান্য গবেষণার ফলাফল থেকে দেখা গেছে টিকা গ্রহণ অ্যান্টিবডির মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে দেয়; দেহের প্রতিরোধ সক্ষমতাকে প্রায় ৫০ গুণ বর্ধিত করে। বিশেষজ্ঞরা সবাই একমত যে যারা কখনোই কভিড-১৯ এ আক্রান্ত হননি তারা কভিড আক্রান্তদের মতো প্রতিরোধ সক্ষমতা অর্জন করতে পারবেন না। কারণ, একটি জীবন্ত ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা আর একটি একক ভাইরাল প্রোটিনের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার অভিজ্ঞতা এক না। এবং যারা কভিড-১৯ আক্রান্ত হয়েছেন তাদের ক্ষেত্রে অ্যান্টিবডির পরিপক্বতা অর্জনে ছয় থেকে ১২ মাস সময় লাগবে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর