মঙ্গলবার, ১ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

সব হারিয়ে ভয়ংকর খুনি

মির্জা মেহেদী তমাল

সব হারিয়ে ভয়ংকর খুনি

মেহেরপুরের ইন্নাত আলী দেশে কোনো কাজই পাচ্ছেন না। ব্যবসা করতে গিয়েও বার বার লোকসান গুনতে হচ্ছে তাকে। স্ত্রী-সন্তানের মুখে তাকিয়ে বিদেশ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন ইন্নাত। সৌদি যাওয়ার ভালো একটা পথও পেয়ে গেলেন তিনি। একই এলাকার রবিউল দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে লোক পাঠান। এই খবর পেয়ে ইন্নাত আলী রবিউলের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ঢাকার পল্টনে রবিউলের অফিস। রবিউল তাকে জানান, ৮ লাখ টাকা দিলে ভালো একটা চাকরি দিয়ে সৌদি আরব পাঠাতে পারবেন তিনি।

পরিবারের ভাগ্য ফেরানোর স্বপ্ন নিয়ে ঋণ ও জমি বিক্রির ৮ লাখ টাকা রবিউলের হাতে তুলে দেন ইন্নাত আলী। কথা ছিল সৌদি আরবে ‘ক্লিনার’-এর চাকরি দেওয়ার। সৌদিতে পাঠানোও হয় তাকে। তবে কাজ দেওয়া হয় উত্তপ্ত মরুভূমিতে রাস্তা মেরামতের। সব কষ্ট সহ্য করে বেতন ছাড়াই ছয় মাস কাজ করেন ইন্নাত। একপর্যায়ে তাকে চাকরি থেকে বাদ দেওয়া হয়। উপায় না দেখে ইন্নাত দেশে ফিরে রবিউলের কাছে টাকা ফেরত চান। রবিউল তাকে ঢাকা আসতে বলে। দুজন মিলে রাজধানীর ফকিরাপুলে বাবুল নামের এক ব্যক্তির অফিসে যায়। বাবুলের মাধ্যমেই ইন্নাত আলীকে সৌদি পাঠানো হয়েছিল।

বেশ কয়েক দিন অফিসে গিয়ে বাবুলের দেখা না পেয়ে ক্ষুব্ধ হন ইন্নাত আলী। রবিউলের কাছে টাকা দাবি করেন তিনি। বলেন, ‘আমি টাকা দিয়েছি তোমাকে, অন্য কাউকে আমি চিনি না।’ রবিউল তাকে বোঝায়। বলে, আমি ৫০ লাখ টাকা পাই বাবুলের কাছে। এরপর টাকা না দিলে তাকে মেরে ফেলব। রবিউল এতে শান্ত হয়। তারা দুজনে মিলে বাবুলকে হত্যার পরিকল্পনা আঁটে। নির্ধারিত দিনে তারা দুজন বাবুলের অফিসে যায়। যাওয়ার আগে রবিউল একটি হাতুড়ি দেয় ইন্নাত আলীর হাতে। তাকে শিখিয়ে দেয়, টাকা না দিলে, এই হাতুড়ি দিয়ে তাকে হত্যা করব। ২০১৮ সালের জুলাইয়ে তারা যায় সেই অফিসে। কিন্তু বাবুলকে তারা পায় না। ইন্নাতের ধারণা, এসব রবিউলের কারসাজি। এ নিয়ে তাদের মধ্যে শুরু হয় তর্কবিতর্ক। কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে ইন্নাত হাতুড়ি দিয়ে রবিউলকে সজোরে উপর্যুপরি আঘাত করতে থাকে। একপর্যায়ে রবিউল মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। বছর খানেক পলাতক থাকার পর ফরিদপুর থেকে গ্রেফতার হন ইন্নাত আলী। ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট দেলোয়ার হোসাইনের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে সব খুলে বলেন। ডিবি পুলিশ রবিউল হত্যা মামলায় ইন্নাত আলীকে আসামি করে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে অভিযোগপত্রও দাখিল করেছে। পল্টন থানায় হত্যা মামলাটি হয়।

হত্যার প্রায় এক বছর পর ফরিদপুর থেকে ইন্নাত আলী গ্রেফতার হয়। তিনি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের পরিদর্শক হুমায়ুন কবির বলেন, ৮ লাখ টাকায় সৌদি গিয়ে সুবিধা করতে না পেরে ইন্নাত আলী দেশে ফিরে রবিউলের কাছে টাকা ফেরত চায়। রবিউল এ সময় বাবুলের কাছে ৫০ লাখ টাকা পাবেন বলে জানায় এবং ইন্নাতকে ঢাকা আসতে বলেন। বাবুল টাকা না দিলে দুজন মিলে বাবুলকে মেরে তার কাছে থাকা নগদ টাকা নিয়ে আসব বলেও রবিউল তাকে জানান। পরিকল্পনা অনুযায়ী বাবুলকে মারার জন্য ইন্নাতকে একটি হাতুড়ি দেয় রবিউল। দুই দিন অফিসে গিয়ে বাবুলের সন্ধান না পেয়ে ইন্নাত ক্ষিপ্ত হয় রবিউলের ওপর। কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে রবিউল তার স্ত্রী-মেয়েকে নিয়ে বাজে কথা বলে। এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে রবিউলের দেওয়া হাতুড়ি দিয়েই তাকে হত্যা করে ইন্নাত। ইন্নাত আলী আদালতকে বলেছেন, টাকা দেওয়ার এক বছর আগে রবিউলের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। জমি বিক্রি করে ৭ লাখ টাকা জোগাড় করি। মেডিকেল ও পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের কথা বলে আরও ১ লাখ টাকা নেয়। সৌদি গিয়ে মরুভূমিতে কাজ করতে বাধ্য করা হয়। রবিউলকে জানালে সে আমাকে অপেক্ষা করতে বলে। কোনো বেতনও দেওয়া হয়নি। বাবুলের কথা বলে রবিউল আমাকে ঘোরায়। একপর্যায়ে সে আমার স্ত্রী-কন্যাকে গালাগালি দিলে আমি আর সহ্য করতে পারিনি। হাতুড়ির এলোপাতাড়ি আঘাতে ওর মাথা থেকে রক্ত বের হতে দেখে হাতুড়ি ফেলে পালিয়ে গ্রামের বাড়ি মেহেরপুরের গাংনীতে যাই। পরের দিন রবিউলের মারা যাওয়ার খবর শুনে গ্রাম থেকে পালিয়ে ফরিদপুরে গিয়ে একটি আড়তে কাজ শুরু করি। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক শ্রেণির আদম ব্যবসায়ীর প্রতারণার ফাঁদে পড়ে সাধারণ মানুষ নিঃস্ব হয়ে পড়ে। সব হারিয়ে এরা পরবর্তীতে অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। মেহেরপুরের ইন্নাত আলীও কোনো অপরাধী ছিলেন না। সব হারিয়ে এই ব্যক্তিটি হয়ে ওঠে একজন খুনি। ইন্নাত আলী বিদেশ যাওয়ার ব্যাপারে কোনো খোঁজখবর ছাড়াই রবিউলের হাতে টাকা তুলে দেন। পরে তিনি প্রতারণার শিকার হন। আর প্রতারণার শিকার হওয়ার পর তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে বিষয়টি জানাননি। যে কারণে সব হারিয়ে নিজেই হয়ে ওঠেন ভয়ঙ্কর খুনি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর