রবিবার, ৬ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

সংক্রমণের হটস্পটগুলোতেই নমুনা পরীক্ষা কম

করোনায় ২৪ ঘণ্টায় ৪৩ জনের মৃত্যু, শনাক্ত ১৪৪৭

শামীম আহমেদ

সংক্রমণের হটস্পটগুলোতেই নমুনা পরীক্ষা কম

দেশের যেখানে করোনা সংক্রমণ বেশি, সেখানেই কম নমুনা পরীক্ষা! বর্তমানে দেশের সবচেয়ে কম শনাক্তের হার ঢাকা বিভাগে হলেও অর্ধেকের বেশি নমুনা পরীক্ষাই হচ্ছে এই বিভাগে, যার বড় অংশ হচ্ছে ঢাকা মহানগরীতে। বাকি অর্ধেক নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে সাত বিভাগে। এর মধ্যে বরিশাল ছাড়া বাকি ছয় বিভাগেই শনাক্তের হার ঢাকার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ বা তার বেশি। অনেক এলাকায় শনাক্তের হার ৭০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়েছে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট। অথচ অধিক সংক্রমিত এলাকাগুলোয় বাড়েনি নমুনা পরীক্ষা। হচ্ছে না কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং (রোগীর সংস্পর্শে যাওয়া ব্যক্তি শনাক্ত)। ফলে শনাক্ত হচ্ছে না রোগী, নীরবে বাড়ছে সংক্রমণ। এসব এলাকা থেকে সারা দেশে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এদিকে চলতি মাসের পাঁচ দিনই ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে করোনা রোগী শনাক্তের হার। গত ২৪ ঘণ্টার নমুনা পরীক্ষায় শনাক্তের হার ছিল ১১ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ, যা গত ৩৯ দিনের মধ্যে সর্বোচ্চ। এই সময়ে মারা গেছেন ৪৩ জন, যা ২৭ দিনের মধ্যে সর্বাধিক মৃত্যু। গত এক দিনে দেশে ১ হাজার ৪৪৭ জনের দেহে সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যে দেখা গেছে, খুলনা ও রাজশাহীর অধিকাংশ জেলায় ও রংপুরের কয়েকটি জেলায় দ্রুত বাড়ছে সংক্রমণ। তবে সেই অনুপাতে ওই জেলাগুলোয় নমুনা পরীক্ষা বাড়ছে না। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ১৩ হাজার ১১৫টি নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগেই হয়েছে ৬ হাজার ৯২৯টি, যা মোট নমুনার ৫২ দশমিক ৮৩ শতাংশ। অন্যদিকে চট্টগ্রাম বিভাগে ২ হাজার ৩৩৪টি (১৭ দশমিক ৮০ শতাংশ), ময়মনসিংহ বিভাগে ৩০৫টি (২ দশমিক ৩৩ শতাংশ), রাজশাহী বিভাগে ১ হাজার ২১৫টি (৯ দশমিক ২৬ শতাংশ), রংপুর বিভাগে ৩৭৯টি (২ দশমিক ৮৯ শতাংশ), খুলনা বিভাগে ৮৮৪টি (৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ), বরিশাল বিভাগে ৫৯৫টি (৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ) ও সিলেট বিভাগে ৪৭৪টি (৩ দশমিক ৬১ শতাংশ) নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। এই নমুনা পরীক্ষায় সর্বোচ্চ ২৮ দশমিক ৫১ শতাংশ সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে খুলনা বিভাগে। এ ছাড়া রাজশাহীতে ২৩ দশমিক ৭০ শতাংশ, সিলেটে ১৭ দশমিক ৫১ শতাংশ, রংপুরে ১৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ, চট্টগ্রামে ১৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ, ময়মনসিংহে ৮ দশমিক ৫২ শতাংশ, বরিশালে ৬ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ ও সর্বনিম্ন ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ শনাক্তের হার ছিল ঢাকা বিভাগে। এ ছাড়া মোট নমুনা পরীক্ষার ৪৪ দশমিক ৭৭ শতাংশই (৫ হাজার ৮৭১টি) হয়েছে ঢাকা মহানগরীতে। শনাক্তের হার ছিল ৪ দশমিক ১০ শতাংশ। অথচ খুলনা বিভাগের বাগেরহাট জেলায় নমুনা পরীক্ষা হয় মাত্র ৭টি, শনাক্তের হার ছিল ৮৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ। সাতক্ষীরায় শনাক্তের হার ৪৭ দশমিক ৩৪ শতাংশ, নমুনা পরীক্ষা হয় ১৮৮টি; খুলনায় শনাক্তের হার ২৯ দশমিক ২৩ শতাংশ, নমুনা পরীক্ষা হয় ৩০১টি; ঝিনাইদহে শনাক্তের হার ৩৫ দশমিক ২৯ শতাংশ, নমুনা পরীক্ষা হয় ১৭টি; এই সময়ে মাগুরা ও নড়াইলে কোনো নমুনা পরীক্ষা হয়নি। এ ছাড়া  ফরিদপুরে শনাক্তের হার ৪৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ, নমুনা পরীক্ষা হয় ৬২টি; রাজশাহীতে শনাক্তের হার ৪৬ দশমিক ১৮ শতাংশ, নমুনা পরীক্ষা হয় ২৮৮টি; চাঁপাইনবাবগঞ্জে শনাক্তের হার ৫৫ দশমিক ১৫ শতাংশ, নমুনা পরীক্ষা হয় ১৯৪টি; কুড়িগ্রামে শনাক্তের হার ৩০ দশমিক ৪৩ শতাংশ, নমুনা পরীক্ষা হয় ২৩টি। মের শেষ সপ্তাহে ঢাকা জেলায় শনাক্তের হার ছিল ৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ, নমুনা পরীক্ষা হয় ৩২ হাজার ৬৭২টি, যা সারা দেশের নমুনা পরীক্ষার ৩৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ। সংক্রমণের হটস্পট চাঁপাইনবাবগঞ্জে শনাক্তের হার ছিল ৫১ দশমিক ৯৬ শতাংশ; নমুনা পরীক্ষা হয় মাত্র ৫৬২টি, যা মোট নমুনা পরীক্ষার শূন্য দশমিক ৬১ শতাংশ। এদিকে গত মে মাসের শেষ সাত দিনে (২৫ থেকে ৩১ মে) দেশে নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ১ লাখ ৯ হাজার ২১৮টি। গত ২ জুন বিকাল পর্যন্ত রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) বিভাগভিত্তিক করোনা সংক্রমণের হালনাগাদ পরিসংখ্যানে মের শেষ সাত দিনে ৯১ হাজার ৬৪৫টি নমুনা পরীক্ষার তথ্য দেয়। তাতে দেখা গেছে, এই সময়ে ঢাকা বিভাগে শনাক্ত হারের গড় ছিল ৬ দশমিক ৩২ শতাংশ, যা সবগুলো বিভাগের মধ্যে সর্বনিম্ন। অথচ নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ৪৪ হাজার ২৭৯টি, যা মোট নমুনা পরীক্ষার ৪৮ দশমিক ৩২ শতাংশ। সর্বোচ্চ (১৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ) শনাক্তের হার ছিল খুলনা বিভাগে। নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ৫ হাজার ১৫৩টি, যা মোট নমুনা পরীক্ষার মাত্র ৫ দশমিক ৬২ শতাংশ।

এ ব্যাপারে আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ঢাকায় মানুষ বেশি, নমুনা পরীক্ষার সুযোগ বেশি, তাই পরীক্ষাও বেশি। অন্য জায়গায় সুযোগ কম। এ ছাড়া ঢাকার বাইরে করোনা শনাক্ত হলে সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ভয়ে অনেকে পরীক্ষা করায় না। এ ব্যাপারে প্রশাসনকে উদ্যোগ নিয়ে মানুষকে নমুনা পরীক্ষায় আগ্রহী করতে হবে। সংক্রমণ যেখানে বেশি, সেখানে অবশ্যই নমুনা পরীক্ষা বাড়াতে হবে। এ ছাড়া এখন শুধু ভারতফেরতদের কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং করা হচ্ছে, এই কাজটা দেশের মধ্যে সংক্রমিতদের ক্ষেত্রেও করা জরুরি।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, গতকাল পর্যন্ত দেশে মোট করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে ৮ লাখ ৯ হাজার ৩১৪ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন ১২ হাজার ৮০১ জন, সুস্থ হয়েছেন ৭ লাখ ৪৯ হাজার ৪২৫ জন। পূর্ববর্তী সপ্তাহের তুলনায় গত সপ্তাহে (৩ মে থেকে ৫ জুন) শনাক্ত বেড়েছে ২৩ শতাংশের বেশি ও মৃত্যু বেড়েছে ২৫ শতাংশের বেশি। ঢাকার বাইরে থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যানুযায়ী, খুলনায় হঠাৎ করে করোনা রোগীর চাপ বেড়ে গেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় খুলনা মেডিকেল কলেজের পিসিআর ল্যাবে রেকর্ড ১১০ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছেন। মারা গেছেন ৫ জন। খুলনা ১০০ শয্যার করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে ভর্তি আছেন ১১৩ জন। আইসিইউতে জরুরি চিকিৎসাধীন আছেন ১০ জন। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের করোনা ইউনিটে আরও আটজনের মৃত্যু হয়েছে গত এক দিনে। হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডগুলোতে ২২৪ জন রোগী চিকিৎসাধীন ছিলেন গতকাল। চাঁপাইনবাবগঞ্জে গত এক দিনে করোনা শনাক্ত হয়েছে ১০৭ জনের, মারা গেছেন ৫ জন। নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার প্রায় ৬০ শতাংশ। বাগেরহাটের মোংলায় হু-হু করে সংক্রমণ বাড়ায় স্থানীয় প্রশাসনকে সহায়তায় মাঠে নেমেছে কোস্টগার্ড। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনার এই হটস্পটে ৪৮ জনের নমুনা পরীক্ষায় ৩৪ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তের হার প্রায় ৭১ শতাংশ। অবশ্য কেন্দ্রীয়ভাবে স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে গতকাল এ তথ্য জানানো হয়নি।

সর্বশেষ খবর