রবিবার, ৬ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

ভয়ংকর হচ্ছে বজ্রপাত বাড়ছে মৃত্যুঝুঁকি

জীবন রক্ষায় নেই সচেতনতা ও প্রস্তুতি - হাওরাঞ্চলে ঝুঁকি প্রশমনে ‘হাওর রিস্ক ম্যানেজমেন্ট’ প্রকল্প

জিন্নাতুন নূর

চলতি মৌসুমেও বজ্রপাতে উদ্বেগজনক হারে মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। বজ্রপাতকে সরকার দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করলেও এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই। মানুষের মধ্যেও সচেতনতার ঘাটতি রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, বজ্রপাতের সময় মানুষের নিজেদের রক্ষা করার প্রস্তুতি নেই। আবার অনেকে বুঝতেই পারেন না যে বজ্রপাতের সময় তাদের করণীয় কী। আগের চেয়ে উন্মুক্ত স্থানে এখন মানুষজন বেশি চলাচল করছেন যা বজ্রপাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। দেশের নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ এবং সিলেটসহ বিস্তীর্ণ হাওরাঞ্চল, উত্তরাঞ্চল ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বজ্রপাতে প্রাণহানির ঘটনা বেশি ঘটছে। বজ্রপাতের ঝুঁকি কমাতে সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর হাওরাঞ্চলে ‘হাওর রিস্ক ম্যানেজমেন্ট’ নামক প্রকল্পও হাতে নিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বজ্রপাত বিষয়ে যত বেশি প্রচার চালানো হবে ততই ক্ষতির হার কমবে। ঝুঁকি কমাতে বাসাবাড়িতে বজ্রপাত নিরোধক অ্যান্টেনা ব্যবহার করার কথাও বলেন তারা। গতকালও শরীয়তপুরে দুজন, মাদারীপুর ও ঢাকার ধামরাইয়ে দুজনসহ ছয় ব্যক্তি বজ্রপাতে মারা গেছেন।

ফাউন্ডেশন ফর ডিজাস্টার ফোরামের তথ্যে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত মোট ১২৬ জন বজ্রপাতে মারা যান। এর মধ্যে ২৬ জন শিশু, নারী ১৫ এবং পুরুষ ৮৫ জন। এপ্রিলের (৭ জন) তুলনায় মে মাসে বেশি সংখ্যক মানুষ (১১৯ জন) বজ্রপাতে মারা যায়। এর আগে ২০২০ সালে বজ্রপাতে মোট ৩৮০ জন মানুষের মৃত্যু ঘটে। ডিজাস্টার ফোরামের সমন্বয়কারী মেহেরুন নেসা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সাধারণত মে মাসে বরাবরই বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি থাকে। চলতি মে মাসেও একই অবস্থা। এখন পর্যন্ত চলতি বছরে নেত্রকোনায় বজ্রপাতে সর্বাধিক সংখ্যক মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। এর কারণ ধান কাটার জন্য এই সময় কৃষকরা মাঠে কাজ করেন। আর মাঠে কাজ করার সময় বজ্রপাতে কৃষকদের অনেকেই মৃত্যুবরণ করেন। দেশে এই দুর্যোগ নিয়ে সচেতনতার অভাব রয়েছে। এ বিষয়ে আরও অনেক কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, অনেকেই বুঝতে পারেন না যে বজ্রপাতের সময় কী করবেন। সরকারের পক্ষ থেকে বজ্রপাতের ঝুঁকি কমাতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় তালগাছের চারা রোপণ করা হচ্ছে। তবে এটি সময়সাপেক্ষ পদক্ষেপ। এর সঙ্গে পরিচর্যার বিষয়ও জড়িত।

বিশেষজ্ঞরা জানান, সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য যে মেঘের সৃষ্টি হয় এর ফলে মেঘের ওপর ও নিচের স্তরে যে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হওয়ার কথা অর্থাৎ এর পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসার যে প্রবণতা তা আগের চেয়ে বেশি। এর কারণ দেশের মানুষ এখন মেটালিক বডির পণ্য বেশি ব্যবহার করছে। অন্যদিকে আগে শহর-গ্রামে যে সংখ্যক উঁচু গাছ ছিল তা এখন কমে এসেছে। এজন্য বজ্রপাতের সংখ্যা বাড়ছে অর্থাৎ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মেঘের ধরনে পরিবর্তন আসছে। যখনই মাথার ওপর আমরা গভীর কালো মেঘ দেখব তখনই বুঝতে হবে যে এখানে বজ্রপাতের আশঙ্কা রয়েছে। এই অবস্থায় নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে হবে। খোলা জায়গায় কোথাও আশ্রয় না থাকলে নিজেকে গুটিয়ে বসতে হবে। একইভাবে হাওর বা নদীতে বসে থাকলেও গুটিয়ে বসতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগবিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, আগের তুলনায় বাংলাদেশে বজ্রপাত যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে একই সঙ্গে এতে মানুষের মৃত্যুর হারও বেড়েছে। আবার বজ্রপাতের সময় মানুষের নিজেদের রক্ষা করার প্রস্তুতিও নেই। আগের চেয়ে উন্মুক্ত স্থানে এখন মানুষ বেশি চলাচল করে। এ সময় তাদের সঙ্গে থাকা মেটালিক বস্তু যেমন মোবাইলের কারণে বজ্রপাতে ক্ষতির আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়। প্রাকৃতিক এই দুর্যোগ যেহেতু বন্ধ করা সম্ভব নয় তাই এ সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে। বাসাবাড়িতে বজ্রপাত নিরোধক অ্যান্টেনা ব্যবহার করা যেতে পারে। বিশ্বে এখন ইউরোপসহ বহু দেশে বজ্রপাত হবে কি না তা আগাম জানার সেন্সর প্রযুক্তি চলে এসেছে। তিনি বলেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর থেকে বজ্রপাত নিরোধের জন্য কিছু উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। এমনকি অনেক গবেষক দেশের কোথায় বজ্রপাত বেশি হয় তার ম্যাপিং করেছেন। এর সাহায্যে কোথায় বজ্রপাত হবে তা আগাম বের করে যদি সাধারণকে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সতর্ক করা যায় তবে প্রাণহানি কমিয়ে আনা সম্ভব।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. আতিকুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বজ্রপাতের ঝুঁকি কমাতে তালগাছ রোপণের বিষয়টি ধারাবাহিক একটি প্রক্রিয়া। কিন্তু বজ্রপাত নিরোধ করার সক্ষমতা অর্জন করতে এই গাছের অনেক সময় প্রয়োজন। এজন্য ‘হাওর রিস্ক ম্যানেজমেন্ট’ নামে নতুন একটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। মূলত দেশের হাওর এলাকার যে বিস্তীর্ণ অঞ্চল সেখানে বজ্রপাতের ধরন দেখা হবে। এসব এলাকায় ঘরবাড়ি না থাকায় কেউ বজ্রপাতের সময় আশ্রয় নিতে পারে না। এজন্য ঝুঁকি বেশি থাকায় এই হাওর এলাকা ঘিরেই সরকার প্রথম প্রকল্প নিতে যাচ্ছে। প্রাথমিক পর্যায়ে নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও ভৈরবে এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে। এসব এলাকায় কিছু স্থাপনা গড়ে তোলা হবে। সেখানে কিছু বজ্রপাত প্রতিরোধক দন্ড স্থাপন করা হবে। আর দ্বিতীয় পর্যায়ে বরেন্দ্র অঞ্চল ও যেখানে মাঠের পরিমাণ বেশি এবং আশ্রয় নেওয়ার স্থান নেই সেসব এলাকায় আরও কিছু প্রকল্প নেওয়া হবে।

সর্বশেষ খবর