মঙ্গলবার, ৮ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

ঢাকার প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শন লালকুঠি

মোস্তফা মতিহার

ঢাকার প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শন লালকুঠি

বুড়িগঙ্গার তীরে দাঁড়িয়ে থেকে আজও ইতিহাসের অংশ হয়ে কালের বিবর্তনের স্বাক্ষী দিচ্ছে লালকুঠি। এটি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অন্যতম প্রাচীন ও সৌন্দর্যময় স্থাপত্যিক একটি নিদর্শন। ঢাকার ৪০০ বছরের প্রাচীন ইতিহাসের গর্বিত অংশও এই লালকুঠি।

বুড়িগঙ্গার ঢেউয়ের সঙ্গে মিতালি করে এই ভবনটি একসময় জমে উঠত আড্ডা আর আনন্দে। এটির জৌলুস ছিল প্রমত্তা বুড়িগঙ্গার মতোই। কিন্তু এখন বুড়িগঙ্গার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দিন দিন লালকুঠিও হারিয়েছে তার জৌলুস। ইতিহাসের গর্বিত অংশীদার প্রাচীন নান্দনিকতার স্থাপত্যিক এই নিদর্শনটি নতুন প্রজন্মের কাছে রূপকথার কোনো গল্পের মতোই। পর্যাপ্ত প্রচারের অভাবে লালকুঠিকে ভুলতে বসেছে জনসাধারণ। কালের বিবর্তনের নীরব এই স্বাক্ষীর বিষয়ে জনমনে ধারণা দিতে না পারলে শুধু লালকুঠিই কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে না, হারিয়ে যাবে ঢাকার খন্ডিত ইতিহাসও। ১৮৭৪ সালে ভারতের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল জর্জ ব্যরিং নর্থব্রুক ঢাকা সফরে আসেন। ওই সফরকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ১৮৭২ সালে টাউন হল হিসেবে ভবনটির নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়। ভবনটির নির্মাণের জন্য ওই সময়কার ভাওয়াল রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ রায়চৌধুরী ১০ হাজার টাকা দান করেন। ১৮৭৯ সালের শেষের দিকে নর্থব্রুক হলের নির্মাণ কাজ শেষ হয়। আর ১৮৮০ সালের ২৫ মে এই ভবনটির উদ্বোধন করেন ঢাকার তৎকালীন কমিশনার। ওই সময় ঢাকার স্থানীয় ধনাঢ্য ব্যক্তিরা গভর্নর জেনারেল নর্থব্রুকের সম্মানে এই ভবনের নাম দেন নর্থব্রুক হল। শুধু তাই নয়, নর্থব্রুকের সম্মানে এ ভবনটি সংলগ্ন সড়কটির নামকরণও করা হয় ‘নর্থব্রুক হল রোড’ নামে। এই ভবনেই আয়োজন করা হতো তৎকালীন পদস্থ রাজকর্মচারী ও ধনাঢ্য ব্যক্তিদের সভা এবং অন্যান্য আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম। পরবর্তীতে ১৮৮২ সালে এটিকে টাউন হল থেকে পাঠাগারে রূপান্তর করা হয়। ওই সময় ঢাকার নবাব আহসান উল্লাহসহ স্থানীয় গণমান্যরা লাইব্রেরিটিতে অনেক বই উপহারস্বরূপ প্রদান করেন। পরে, ১৮৮৭ সালে এই পাঠাগারের জন্য ইংল্যান্ড থেকেও আনা হয় বেশ কিছু বই। যার কারণে স্বল্পসংখ্যক বই নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও কয়েক বছরের মধ্যে পাঠাগারটির বইয়ের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যায়।

তবে, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাঠাগারের অধিকাংশ বই নষ্ট হয়ে যায়। মূল্যবান ও দুর্লভ বই ছাড়াও লাইবেরিটিতে রাখা হয় বেশ কয়েকটি দৈনিক পত্রিকা। স্থানীয় মানুষজন পাঠাগারটিতে এসে বই ও পত্রিকা পড়ে থাকেন। দুইজন কেয়ারটেকার দিয়েই পরিচালিত হচ্ছে গ্রন্থাগারটি। লালকুঠির দক্ষিণ-পূর্ব কোনের একটি জরাজীর্ণ ভবনে অবস্থিত পাঠাগারটির হারানো ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। লালরঙে রাঙানো থাকার কারণে নর্থব্রুক হলের পরিবর্তে স্থানীয় জনসাধারণ এটিকে লালকুঠি নামেই ডাকা শুরু করে। ফলে, লালকুঠি নামেই টাউন হলটি ব্যাপক পরিচিতি পায়। পাকিস্তান আমলেই লালকুঠি তার ঐতিহ্য হারাতে শুরু করে। কর্তৃপক্ষের অবহেলায় শ্রীহীন হয়ে পড়ে ভবনের লাইব্রেরিটি। সময়ের প্রয়োজনে এখানে গড়ে ওঠা ভবনগুলো লালকুঠির সৌন্দর্যকে ম্লান করে দিয়েছে বলে মনে করেন স্থানীয় জনগণ। বর্তমানে ভবনটির দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা সিটি করপোরেশন। ২০০৮-এর বিধি অনুযায়ী রাজউক কর্তৃক মহাপরিকল্পনাভুক্ত স্থাপনা হিসেবে নর্থব্রুক হল তথা লালকুঠিকে সংরক্ষণের জন্য তালিকাভুক্ত করা হলেও ঐতিহাসিক এই লালকুঠির জৌলুস ফিরিয়ে আনতে প্রশাসনের কোনো আন্তরিকতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না বলে জানান অত্র এলাকার বাসিন্দারা।

সর্বশেষ খবর