বুধবার, ১৬ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

লাশটি চরমপন্থির নয় একজন ব্যবসায়ীর

মির্জা মেহেদী তমাল

লাশটি চরমপন্থির নয় একজন ব্যবসায়ীর

বাসা থেকে বেড়িয়ে আর ফিরে আসেননি শহীদুল ইসলাম। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পরিচিত সব স্থানে খোঁজ নেওয়া হয়েছে। পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়। পুলিশ তার খোঁজ করতে থাকে। কিন্তু শহীদুলের অবস্থান কোথায়- তা বের করা যাচ্ছে না। পরিবারের কেউ কিছু বুঝে উঠতে পারছে না, শহীদুল কোথায় গেছে। ঘটনাটি কুষ্টিয়ার। ২০১৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর নিখোঁজ হন শহীদুল ইসলাম। শহীদুলের মা তমিরুন নেসার কাছে নিখোঁজ বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের খবর আসতে থাকে। এর মধ্যে নিখোঁজের সঙ্গে জড়িয়ে একটি নাম বেশ কয়েক জনের কাছ থেকেই জানতে পারেন। আর তা হলো শহীদুল ইসলামের শ্যালকেরর স্ত্রী রোজিনা বেগম। শহীদুলের এ নিখোঁজের পেছনে রোজিনার হাত থাকতে পারে বলে অনেকের অভিযোগ। শহীদুলের মা প্রথমে বিষয়টি গুরুত্ব দেননি। কিন্তু এক সময়ে সন্দেহ হতে থাকে। কারণ শহীদুলের সঙ্গে তার শ্যালকের স্ত্রী রোজিনার একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। যে সম্পর্ক নিয়ে আলাপ-আলোচনাও হয়েছে বিস্তর। এমন অভিযোগ নিয়ে থানায় যান শহীদুলের মা। কিন্তু পুলিশ বিষয়টিকে পাত্তা না দিয়ে বিদেয় করে দেয়। কয়েক মাস পেরিয়ে যায়। শহীদুলের নিখোঁজ বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। ধামাচাপা পড়তে থাকে নিখোঁজ ঘটনাটি। শহীদুল ছিল কুষ্টিয়ার গরু ব্যবসায়ী। শহীদুলের মা তমিরুন নেসা কুষ্টিয়ার আদালতে একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় শহীদুলের শ্যালক মোতাহারের স্ত্রী রোজিনা বেগম, তার বাবা জব্বার শেখ ও মা মতিরন নেসাকে সরাসরি আসামি করা  হয়। আদালত প্রাথমিক পর্যায়ে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব দেন পিবিআইকে। পিবিআইয়ের তদন্তে বিষয়টির সত্যতা মিললে পরে থানা পুলিশকে নিয়মিত মামলা হিসেবে গ্রহণের নির্দেশ দেয়। কিন্তু তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই। এভাবেই কেটে যায় দুই বছর। পুলিশ সদর দফতর ২০১৯ সালের নভেম্বরে অপহরণ মামলাটি সিআইডিকে তদন্তের নির্দেশ দেয়। সিআইডি অপহরণ মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার প্রায় এক বছর পর ২০২০ সালে কুমারখালী থেকে রোজিনা বেগমকে গ্রেফতার করে। রোজিনাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে হয়নি। তিনি নিশ্চিত ছিলেন, ধরা তাকে পড়তেই হবে। তিনি খুনের ঘটনার আদ্যোপান্ত স্বীকার করে নেন। কিন্তু কেন তিনি খুন করলেন- এমন প্রশ্নের জবাবে রোজিনার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে নিষিদ্ধ প্রেমের গল্প। যার পরিণতি ছিল রক্তারক্তি খুনের মধ্যদিয়ে। শহীদুলের শ্যালক মোতাহার। মোতাহার প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন রোজিনা বেগমকে। শহীদুলের বাড়িতেই স্ত্রীকে নিয়ে ওঠেন। এক বাড়িতে থাকার কারণে শহীদুল ইসলামের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয় শ্যালকের স্ত্রী রোজিনার। এক সময় তারা শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। এ নিয়ে লোকজনের মুখে কানাঘুষা শুরু হয়। মোতাহার স্ত্রীকে নিয়ে আলাদা হয়ে যান। কিছুদিন পর অসুস্থ হয়ে মোতাহার মারা যান। শহীদুলের সঙ্গে সম্পর্ক আবার জোড়া লাগে রোজিনার। ইতিমধ্যে শহীদুলের স্ত্রীও মৃত্যুবরণ করেন। তাতে করে শহীদুল আর রোজিনার প্রেম যেন আরও বেড়ে যায়। রোজিনা একটা সময় চলে যান নিজের মায়ের বাড়ি বগুড়ায়। সেখানেও শহীদুল মাঝে-মধ্যে হানা দিতেন। তাতে বিরক্ত ছিলেন রোজিনা। কয়েক মাস পর রোজিনা মানিকগঞ্জ চলে আসেন। সেখানে চাকরি নেন। খবর পেয়ে যান শহীদুল। সেখানেও যোগাযোগ করেন। কিন্তু মানিকগঞ্জ এসেই রোজিনার সঙ্গে সম্পর্ক হয় একই অফিসের সুপারভাইজার মোমিনের সঙ্গে। মোমিনের স্ত্রী থাকলেও রোজিনাকে ভালোবেসে  কয়েকদিনের মধ্যেই বিয়ে করেন। তাই রোজিনা আর শহীদুলকে পাত্তা দিতে চাননি। কিন্তু শহীদুলও নাছোর। ছাড়তে চান না। ক্ষুব্ধ রোজিনা এ বিষয়টি জানান তার নতুন প্রেমিক মোমিনকে। মোমিন তাকে বলেন, সমস্যা নেই। দুনিয়াতেই থাকবে না শহীদুল। ওকে বিয়ের কথা বলে ডেকে নিয়ে আসো। বাকিটা ও এলে করব। যেই কথা সেই কাজ। রোজিনা যোগাযোগ করেন শহীদুলের সঙ্গে। বলেন, আসো আমরা বিয়ে করব। এভাবে লুকিয়ে আর নয়। একথা শুনে অস্থির শহীদুল। ২০১৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর রাতে বিয়ের কথা বলে শহীদুলকে মাগুরার শ্রীপুরে আসতে বলেন। শ্রীপুরের লাঙ্গলবাদ বাজার থেকে শহীদুলকে রোজিনা ও মোমিন একটি খোলা মাঠে নিনে যান। কিছু দূর যাওয়ার পর রোজিনা ও মোমিন শহীদুলকে জাপটে ধরেন। প্রায় আধা ঘণ্টা ধস্তাধস্তি হয়। এক সময় শহীদুল ক্লান্ত হয়ে পড়েন। রোজিনা তার বুকের ওপরে ওঠে বসেন। দুই হাত চেপে ধরেন। আর মোমেন চাকু চালান গলায়।

শহীদুল নিস্তেজ হয়ে পড়েন। মৃত্যু নিশ্চিত করতে হাত-পায়ের রগ কেটে দেন মোমিন। সেখানে লাশ রেখে তারা মোমিনের বাড়িতে যান। ধস্তাধস্তির সময় চাকুর আঘাতে মোমিন ও রোজিনার হাতও কেটে যায়। তারা বাড়িতে গিয়ে জানান ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে তাদের হাত কেটেছে। ঘটনার পরদিন শ্রীপুর থানার পুলিশ অজ্ঞাত হিসেবে শহীদুলের লাশ উদ্ধার করে। ধারণা করা হয় চরমপন্থির লাশ। অভ্যন্তরীণ কোন্দলে চরমপন্থিরাই তাকে হত্যা করেছে। একটি হত্যা মামলা হলেও থানা পুলিশ তদন্তের কোনো কূলকিনার করতে না পারায় হত্যা মামলার ফাইনাল রিপোর্ট দেয়। লাশ অজ্ঞাত হিসেবেই থেকে যায়। কারণ ওই এলাকায় শহীদুলকে কেউ চিনতে পারেনি। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, অপহরণ মামলা তদন্ত করতে গিয়ে প্রথমে শহীদুলের সর্বশেষ অবস্থান কোথায় ছিল তা শনাক্তের চেষ্টা করা হয়। তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি সর্বশেষ অবস্থান ছিল মাগুরার শ্রীপুরের লাঙ্গলবাদ বাজারে। রোজিনার ব্যবহৃত সিমটিও একই এলাকায় ছিল। এরপর রোজিনাকে ঢাকার আশুলিয়া থেকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তিনি সব স্বীকার করলে মোমিনকেও গ্রেফতার করা হয়। রোজিনার দেওয়া স্বীকারোক্তির পর সিআইডি মাগুরার শ্রীপুর থানায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর ঠিকই ওই এলাকা থেকে একজনের লাশ উদ্ধার হয়। যাকে অজ্ঞাত হিসেবে দাফন করা হয়েছে। হত্যা মামলা হলেও সেটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে।

সর্বশেষ খবর