বৃহস্পতিবার, ১৭ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

জিঘাংসায় সব শেষ

মির্জা মেহেদী তমাল

জিঘাংসায় সব শেষ

টয়লেট থেকে বেরিয়ে উঠান দিয়ে হেঁটে ঘরের দিকে যাচ্ছে নয় বছরের শিশু হাসমি খান। কিন্তু আঁধারে লুকিয়ে থাকা দুই যুবক হঠাৎ তার সামনে এসে দাঁড়ায়। মুখ চেপে তারা হাসমিকে কোলে তুলেই চম্পট। বাড়ির কেউ কিছু আঁচ করতে পারল না। ঘরে থাকা হাসমির বাবাও না। তিনি জানতেও পারলেন না তার প্রিয় সন্তানটির সঙ্গে আর কোনো দিন দেখা হবে না। হাসমি টয়লেট থেকে ফিরছে না বলে তার বুকটা কেমন করে ওঠে। এরপর শুরু হয় খোঁজাখুঁজি। হাসমিকে আর পাওয়া যায়নি। পাওয়া যায় তার লাশ। ঘাতকরা হাসমিকে জবাই করে হত্যার পর সিমেন্টের ব্যাগের সঙ্গে বেঁধে পুকুরে ফেলে দেয়। কিন্তু ঘাতকদের কোনো আশাই পূরণ হয়নি। ঘটনাটি খুলনার। অপহরণের পর খুনের ঘটনাটি চাঞ্চল্যকর শিশু হাসমি মিয়া হত্যা মামলা নামে পরিচিত। খুলনার আড়ংঘাটা থানা এলাকার সরদারডাঙ্গা শহীদ হাতেম আহম্মেদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র হাসমিকে মা সোনিয়া বেগমের সামনেই নৃশংসভাবে খুন করে তিন ঘাতক। বারবার শিশুটি তার মাকে ডেকে ডেকে বলছিল, ‘মা আমাকে বাঁচাও।’ তবুও মা ও তার সহযোগীদের মনে করুণা হয়নি।

খুলনার মানিকতলার জাহাঙ্গীর হোসেন খানের মেয়ে সোনিয়ার সঙ্গে হাফিজুর রহমানের বিয়ে হয়। এর ছয় মাস পর হাফিজুর রহমান বিদেশে চলে যান। স্বামীর অনুপস্থিতিতে সোনিয়ার চলাফেরা উচ্ছৃঙ্খল হতে থাকে। তিনি বিভিন্ন যুবকের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। দেশে আসার পর বিষয়টি জানতে পারেন স্বামী হাফিজুর রহমান। এরপর তিনি স্ত্রীকে শোধরানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত তালাক দেন স্ত্রীকে। হাসমি থেকে যায় বাবার সঙ্গে। কিন্তু সোনিয়া তার সাবেক স্বামীকে চরম শিক্ষা দিতে যান। এ জন্য হাসমিকে তার বাবার কাছ থেকে অপহরণ করার পরিকল্পনা আঁটেন। তার পরিচিত দুই যুবক নুরুন্নবী ও রসুলের সঙ্গে ৫০০ টাকা ও অনৈতিক কাজের চুক্তি হয় সোনিয়ার। ২০১৬ সালের ৬ জুন রাত পৌনে ৯টার দিকে শিশু হাসমিকে অপহরণ করে তার মায়ের কাছে নিয়ে আসা হয়। এরপর চুক্তি অনুযায়ী সরদারডাঙ্গা বাগানের (বাঁশঝাড়) মধ্যে পালাক্রমে অপহরণকারীরা সোনিয়ার সঙ্গে অনৈতিক কাজে লিপ্ত হয়। এ সময় শিশু হাসমি ঘটনা দেখে তার মাকে বলে ‘মা’ তুমি কী করতেছ, আমি বাবাকে বলে দেব। এ ঘটনা বাইরে ছড়িয়ে পড়ার ভয়ে ঘাতকরা মা সোনিয়ার সামনেই শিশু হাসমিকে মুখ চেপে ধরে গলায় ছুরি চালিয়ে হত্যা করে। হত্যার পর লাশ গুমের জন্য ওই রাতেই সিমেন্টের বস্তায় ভরে খুলনা বাইপাস সড়কসংলগ্ন সরদারডাঙ্গা বিলের মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়। এরপর ৯ জুন সকালে খুলনা বাইপাস সড়কসংলগ্ন সরদারডাঙ্গা বিলের মধ্য থেকে সিমেন্টের বস্তাবন্দী অবস্থায় হাসমির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় সেদিনই হাসমির পিতা মো. হাফিজুর রহমান বাদী হয়ে মো. নুরুন্নবী, হাফিজুর রহমান, মো. রসুলের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত দু-তিনজনের বিরুদ্ধে অপহরণের পর হত্যা ও লাশ গুমের মামলা দায়ের করেন। তদন্ত কর্মকর্তা আড়ংঘাটা থানার এসআই মো. মিজানুর রহমান একই বছরের ৩০ জুন এজাহারভুক্ত হাফিজুর রহমান ও আসাদ ফকিরকে বাদ দিয়ে সোনিয়া আক্তার, মো. নুরুন্নবী ও মো. রসুলের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন। ওই চার্জশিটের বিরুদ্ধে বাদীর নারাজি আবেদনের পর পুনরায় তদন্ত শেষে সিআইডির পরিদর্শক মিঠু রানী দাসী একই বছরের ২৮ ডিসেম্বর সাতজনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। মামলার বিচারে হাসমির মা-সহ চারজনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেয় আদালত। এরা হলেন শিশু হাসমির মা সোনিয়া আক্তার, মো. নুরুন্নবী, মো. রসুল ও মো. হাফিজুর রহমান।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাবেক স্বামীকে চরম শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন সোনিয়া। জিঘাংসা মেটাতে নিজের সন্তান শুধু হারাননি, নিজের জীবনও করেছেন শেষ। খুন করে খুনি কখনো পালিয়ে থাকতে পারে না। ধরা পড়তেই হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেভাবেই হোক কোনো না কোনো সূত্র ধরে তাদের গ্রেফতার করবেই। যেভাবে গ্রেফতার হয়েছে এ ঘটনায় জড়িত প্রত্যেকেই।

প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ

গত ৭ জুন বাংলাদেশ প্রতিদিনে গোয়েন্দা কাহিনিতে ‘ডিজে পার্টি প্রেম খুন’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনের কিছু অংশের প্রতিবাদ করেছেন কণিকা। তিনি বলেন, তাকে নিয়ে প্রতিবেদনে প্রকাশিত বেশ কিছু তথ্যগত ভুল রয়েছে। তিনি বলেন, প্রথমে সৈকতের সঙ্গে তার ফোনের দোকানে আমার দেখা হয়। তারপর শুধু বন্ধুত্ব। বন্ধুত্বের একপর্যায়ে সে তার বন্ধুর ছেলের বাসায় একটি অনুষ্ঠানে নিয়ে যায়। সেখানে সৈকত আমাকে ধর্ষণ করে। যেটা আমি পারিবারিক ও সামাজিক কারণে কারও কাছে বলতে পারিনি। আর এটার ওপর ভিত্তি করেই তার সঙ্গে আমার একটি ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হয়। সৈকতের বাসায় আমি প্রায়ই যাওয়া-আসা করতাম। লিখিত বক্তব্যে কণিকা বলেন, আমি কখনো ডিজে পার্টিতে যাইনি। সৈকতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠাতার পর আমি জানতে পেরেছি তার পরিবারের খবর। তাদের পরিবার ইয়াবা ব্যবসা থেকে শুরু করে নানা অপরাধ কর্মকান্ডে জড়িত। সৈকত বিবাহিত, এটাই জানতে পারি পরে। সৈকতের বাবা শাহ আলমও আমার সঙ্গে যে আচরণ করেছেন তা মুখে বলার মতো নয়। সৈকতের ব্যাপারে কথা বলবে বলে আমাকে বাসাবোর এক বাসায় যেতে বলেন সৈকতের বাবা শাহ আলম। সেখানে গিয়ে দেখি একজন মহিলা রয়েছেন। যার সঙ্গে সৈকতের অবৈধ সম্পর্ক রয়েছে। সৈকতের বাবা নিজেই তখন এ কথা জানান। আমার সঙ্গেও খারাপ আচরণ করেন। আমার শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে হাত দেন। আমি চলে আসি কান্নাকাটি করে। জানাই সৈকতকে। সৈকত আমাকে একটি সিম দিয়ে বলে, তার বাবাকে ফোন করতে। অভিনয় করে আসতে বলার জন্য বলে আমাকে। আমি সেটাই করি। সৈকতের বাবা আসেন। যথারীতি সৈকতের বাবা আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি আমাকে জোর-জবরদস্তি করতে থাকেন। সেখানেই আগে থেকে ছিল সৈকত। সে তার বাবাকে ধরে ফেলে। গলা চেপে ধরে। আমি বাধা দেই। কিন্তু পারি না। সৈকত তার বাবাকে মেরে ফেলে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর