বুধবার, ২৩ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

কন্ট্রাক্ট কিলিং দুই ভায়রার

মির্জা মেহেদী তমাল

কন্ট্রাক্ট কিলিং দুই ভায়রার

পুরান ঢাকার একজন ব্যবসায়ী খুনের অভিযোগে ভাড়াটে দুই কিলারকে গ্রেফতার করে পুলিশ। থানায় নিয়ে চলে জেরা। কিন্তু তারা মুখ খোলে না। নানাভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও তাদের কাছ থেকে কোনো তথ্যই মেলে না। পুলিশ বলে, ‘তোরা ব্যবসায়ীর কাছ থেকে চাঁদা না পেয়ে সেদিন হত্যার হুমকি দিয়েছিস। হুমকি দিয়েই তো তোরা খুন করেছিস। এবার বল, কেন করেছিস।’ জবাবে এক কিলার বলে, ‘চান্দার জন্য হুমকি দিছিলাম স্যার। কিন্তু আমরা খুন করিনি। আর যারে খুন করা হয়েছে, তাকে নাকি গলায় দড়ি পেঁচিয়ে ফাঁস লাগায়া খুন করছে। আমরা এমনভাবে খুন করি না। আমাগো বস কইসে, ঠুস কইরা মারতে। মানে গুলি কইরা। আমরা গলা টিপে মানুষ মারি না। তবে অস্ত্র ব্যবসায়ী সাবুরে জিগাইলে কিছু পাইতে পারেন।’ পুলিশের অভিযান এবার সেই অস্ত্র ব্যবসায়ীর আস্তানায়। পুলিশ প্রথমে পুরান ঢাকাতেই এক যুবককে পাঠায় সেই অস্ত্র ব্যবসায়ীর কাছে। যুবকটি অস্ত্র ব্যবসায়ীর কাছ থেকে একটি রিভলবার ভাড়া নেয় ২০ হাজার টাকায়। ঠিক ওই সময়ে পুলিশ হাজির- ‘২৫ তারিখে তুই কাকে অস্ত্র ভাড়া দিয়েছিস’। পুলিশের এমন প্রশ্নে নাম বলে দেয় সে। এবার পুলিশের অভিযান অস্ত্র ভাড়া করে নিয়ে যাওয়া যুবকটির উদ্দেশ্যে। তিন দিন খোঁজ করে মিলল সেই অস্ত্র ব্যবসায়ীকে। সে জানায়, ‘অস্ত্রটি সে এনে দিয়েছে দুই কিলারকে। কিন্তু কার জন্য সেটা জানি না।’ পুলিশের এমন একের পর এক অভিযানে পেরিয়ে গেছে আরও ১৫ দিন। কিন্তু খুনের মাস্টারমাইন্ড কে, তা এখনো স্পষ্ট নয় পুলিশ। কিন্তু চেষ্টা চালাচ্ছে তা জানার জন্য। ২০১২ সালের ২৫ অক্টোবর। ব্যবসায়ী সাইদ হোসেন বাসা থেকে বেরিয়ে আর ফেরেননি। পুরান ঢাকার বংশালের নিখোঁজ এ জমি ব্যবসায়ীর খোঁজে পুলিশ ঢাকা শহর চষে বেড়াচ্ছে। কিন্তু খোঁজ মিলছে না তার। পুলিশ কর্মকর্তারা দফায় দফায় বৈঠক করছেন ধনী ব্যবসায়ী সাইদের নিখোঁজ নিয়ে। ক্লু পাওয়া যাচ্ছে না। সাইদের পরিবারের সদস্যরা পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে ধরনা দিচ্ছে। আশার বাণী নেই কোথাও। সাইদের দুই ভায়রা মিজান ও আবুল এ সময় সাইদ পরিবারকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। তারা ছোটাছুটি করছেন সাইদের খোঁজে।

সাত দিন পর ২০১২ সালে ১ নভেম্বর ঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলার শাক্তা ইউনিয়নের ব্রাহ্মণসুর এলাকা থেকে সাইদের গলিত লাশ উদ্ধার করা হয়। গলায় একটি দড়ি পেঁচানো অবস্থায় ছিল। পুলিশ নিশ্চিত যে, শ্বাসরোধ করে সাইদকে হত্যা করা হয়। সাইদের নিখোঁজ হওয়ার পেছনে দায়ী কারা? কেনই বা তাকে তুলে নেওয়া হবে? কার লাভ এতে? এ নিয়ে চলছে পুলিশের ভিতর তোলপাড়। সাইদের অফিসের পিয়নকে জেরা করে পুলিশ। পিয়ন জানায়, ‘স্যার তো কেরানীগঞ্জে গেছিল জমি দেখতে। একাই গেছিল সেদিন।’ সাইদের সঙ্গে কোনো ঝামেলা আছে কারও? প্রশ্ন পুলিশের। পিয়ন বলে, ‘জমির ব্যবসা করায় প্রায় ঝামেলা হতো। কয়েকদিন আগেও কয়েকজন চাঁদা দাবি করেছেন। তারা ভারতে আত্মগোপনে থাকা দেশের এক শীর্ষ সন্ত্রাসীর নামে চাঁদা তুলতে এসেছিলেন। কিন্তু সাইদ স্যার তাদের বকাঝকা দিয়ে বিদায় করে দেন। যাওয়ার আগে সন্ত্রাসীরা হত্যার হুমকি দিয়ে যায়।’ পুলিশ এমন তথ্য পাওয়ার পর তদন্তে গতি বাড়িয়ে দেয়।

পুলিশ বেশ কয়েকটি অভিযান চালিয়ে দুজনকে গ্রেফতার করে। তাদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে পুলিশ এবার অভিযান চালায় কেরানীগঞ্জে। রাতের আঁধারে পেশাদার কিলারদের আস্তানায় জীবনবাজি রেখে হানা দেয় পুলিশের একটি দল। ধরা পড়ে দুই কিলার। তাদের নিয়ে যাওয়া হয় থানায়। চলে জেরা। মুখ খোলে না। নানাভাবে ভয়ভীতি দেখানো হয়। টানা ৪৮ ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখা হয় এ দুই কিলারকে। একপর্যায়ে তারা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। পড়ে যেতে থাকে। কিন্তু খোঁচা দিয়ে আবারও দাঁড় করিয়ে রাখেন পুলিশ সদস্যরা। কিন্তু আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যায়। তাদের মুখ খুলতেই হয়। সেই পেশাদার কিলার যাদের নাম ফাঁস করেন, তাদের নাম শুনে পুলিশ যেন আকাশ থেকে পড়ে। তারা হতবাক। এও কী সম্ভব! দুই ভায়রা ভাই মিজান আর আবুলের পরিকল্পনায় সাইদকে খুন! এরা দুজন আসামি ধরতে পুলিশের সঙ্গে বিভিন্ন অভিযানেও ছিলেন। পুলিশ আর দেরি করে না। ছুটে যায় সাইদের বাসায়। সেখানেই ছিল সাইদের দুই ভায়রা। পুলিশ দেখে তাদের চেহারা হঠাৎ ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে। পুলিশের চোখ বিষয়টি এড়ায় না। পুলিশ বলে, কী ব্যাপার আপনাদের চেহারা এমন দেখাচ্ছে কেন? ভায়রা দুজন দুজনের দিকে তাকায়। বিষয়টা হালকা করতে একজন বলে, না কী হবে আবার। আমাদের ছোট ভায়রা খুন হলো, আপনারা আসামি ধরছেন না কেন? পুলিশ বলে, আসাসি পেয়ে গেছি। তাদের নিতেই এসেছি। এ কথা বলে পুলিশ দুই ভায়রার হাত ধরে বের করে নিয়ে থানায় যায়। তাদের থানায় নিয়ে যাওয়ার পর জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। কিন্তু তারা উল্টো পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে বলে শাসায়। তখন সেই দুই কিলারকে তাদের মুখোমুখি করে পুলিশ। তখন আর অস্বীকার করতে পারেনি দুই ভায়রা। স্বীকার করে নেয়, তারা এ কন্ট্রাক্ট কিলিংয়ে জড়িত।

দুই ভায়রা পুলিশের কাছে বলে, সাইদ ধনী ব্যবসায়ী। কিন্তু তারা ধনী নয়। যদিও মাঝেমধ্যে সাইদ তাদের মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে সাহায্য করেছেন। কিন্তু সব সময় দিতেন না। এ কারণে সাইদের সম্পদ আত্মসাতের চেষ্টা করতে খুনের পরিকল্পনা আঁটি। আর এ জন্য কেরানীগঞ্জের দুই কিলারকে দেড় লাখ টাকায় ভাড়া করা হয়। পরিকল্পনা মতো জমি দেখানোর কথা বলে সাইদকে কেরানীগঞ্জে নেওয়া হয়, সেখানেই তাকে গলা টিপে হত্যার পর লাশ ফেলে রাখা হয়।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর