বৃহস্পতিবার, ২৪ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

সিরিয়াল দেখে ওরা সিরিয়াল কিলার

মির্জা মেহেদী তমাল

সিরিয়াল দেখে ওরা সিরিয়াল কিলার

বকুল আর তুষার। বাল্যবন্ধু। বয়স তাদের ২০ থেকে ২২। দুজনের বাড়ি বগুড়ার ধুনট উপজেলার চরখুকশিয়া গ্রামে। প্রাইমারি স্কুলে তারা একই সঙ্গে লেখাপড়া করত। একসঙ্গেই চলাফেরা, খেলাধুলা। তুষারের পরিবারে হঠাৎ সিদ্ধান্ত হয়। ঢাকায় যাবে তার মা। সঙ্গে তুষারকে যেতে হবে। অভাবের সংসার তাদের আর চলছে না। তুষার তার মায়ের সঙ্গে ঢাকায় যায়। কিন্তু কোনো কাজ পায়নি তুষারের মা। ছেলেকে নিয়ে সাভার যায়। সেখানে একটি গার্মেন্টে চাকরি নেন তুষারের মা। আর তুষার বসে না থেকে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালাতে শুরু করে। চলছিল বেশ। তুষার হঠাৎ দেখতে পায় তার বন্ধু বকুলকে। বকুলও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালায়। অনেক দিন পর দুই বন্ধুতে আবারও দেখা। আবারও একসঙ্গেই পথচলা শুরু তাদের। বকুলের মা গার্মেন্টে চাকরি নেন। কিছুদিন পর বগুড়া থেকে সাভার আসে বকুলের বন্ধু রাসেল। তুষার, বকুল আর রাসেল। তিন বন্ধুই সাভারে অটোরিকশা চালাতে থাকে। দিন শেষে তিনজন একসঙ্গে আড্ডা দেয়। ঘুরে বেড়ায়। তিনজনের মধ্যেই চরম বন্ধুত্ব। একজনের খাবার থাকলেও ভাগ করে তিনজনে খায়। চলছিল বেশ তাদের জীবন।

এক সময় তাদের মধ্যে হতাশা শুরু হয়। অটো চালিয়ে যে টাকা রোজগার করে, তাতে তাদের আর হচ্ছে না। আরও টাকা দরকার। জীবনে বাঁচতে হলে প্রচুর টাকার প্রয়োজন। কিন্তু এত টাকা পাবে কোথায়? তাদের টাকা দরকার অনেক। তাও খুব দ্রুত। তারা নিজেরা এ নিয়ে বুদ্ধি পরামর্শ করতে চাইলেও পায় না কোনো সোজা পথ। যে পথে দ্রুত টাকা আয় করা যাবে।

হঠাৎ তাদের জীবন যাত্রায় পরিবর্তন আসে। রাতে তারা তিনজনে শলাপরামর্শ করে। রাতে ঘুরে বেড়ায়। কোথায় যায় কী করে, তার  পরিবারের সদস্যদের কাছে অজানা থেকে যায়। তবে অটো চালানো তারা বন্ধ করেনি। কেরানীগঞ্জের আলীপুর গ্রাম অটোরিকশাচালক জাকির হোসেন। ২০১৯ সালের মার্চের শেষ সপ্তাহের এক সন্ধ্যায় অটোরিকশা নিয়ে গ্যারেজ থেকে বেরিয়ে পড়েন। রাতে বাসায় না ফেরায় ফজরের আজানের সময় তার ভাই আবদুল কাদির জাকিরের মোবাইলে কল দেন। ফোনে রিং বাজলেও কেউ ধরছিল না। তখন আশপাশের এলাকায় খোঁজখবর করতে থাকেন। লোকজনের মাধ্যমে জানতে পারেন, কদমতলীর কলাতিয়া টু সাভারের হেমায়েতপুরগামী সড়কের পাশে একটা লাশ পড়ে আছে। ওই লাশটি ছিল জাকির হোসেনের। অটো নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা। লাশ উদ্ধারের পাঁচ দিন পর ২ এপ্রিল রাতে অটোরিকশাচালক মতিউর রহমানের লাশ মেলে ভাকুর্তার পরিত্যক্ত একটি ইটভাটার সামনের সড়কের পাশে। দেহের বিভিন্ন স্থানে ধারালো অস্ত্রের জখম। পর পর দুজন অটো চালকের রক্তাক্ত লাশ উদ্ধারের পর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে অটো চালকদের মাঝে। দুর্বৃত্তরা হত্যা করে অটো নিয়ে যাচ্ছে। এই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে তিন বন্ধুর পরিবারেও। পরিবার থেকে তাদের আপাতত অটো নিয়ে বের হতে নিষেধ করা হয়। তারাও আতঙ্কিত। অটো চালানো বাদ দেয় তারা। ওই ঘটনার ছয় দিন পর সাভারের হেমায়েতপুর ঝাউচরে আরেক ঘটনা। রাতে দুর্বৃত্তরা অটোরিকশাচালক ময়নুলের ওপর হামলা করে। তবে ময়নুলের ভাগ্য ভালো। অটো নিয়ে গেলেও প্রাণ নিয়ে বেঁচে ফিরেছে। ১৫ দিনের ব্যবধানে দুজন অটোচালক খুন এবং একজন আহত হওয়ার ঘটনায় পুলিশের ঘুম হারাম হয়ে যায়। কারা এ কান্ড ঘটাচ্ছে তা মাথাতেই আসছে না পুলিশের। চিহ্নিত সব অটো চোরদের কাছ থেকে সোর্সদের মাধ্যমে তথ্য নিচ্ছে। কিন্তু কেউ বলতে পারছে না। কারা এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে। সর্বশেষ ঘটনার মামলা হওয়ার কয়েক দিন পর পুলিশের কাছে খবর আসে, ছিনতাই হওয়া অটো চলছে রাস্তায়। পুলিশ দ্রুত ছুটে যায়। আটক করে অটোরিকশাটি। অটোরিকশাচালককে পুলিশ জেরা করে। সে জানায়, অটোটি সে তুষার আর রাসেল নামে দুজনের কাছ থেকে অটো কিনেছে। পুলিশ এবার গ্রেফতারে অভিযান চালায়। গ্রেফতার করে তুষার আর রাসেলকে। পরে গ্রেফতার হয় বকুল। তাদের কাছ থেকে বেরিয়ে আসে রোমহর্ষক খুনের ঘটনাগুলো। আদালতেও তারা জবানবন্দি দেয়।

হত্যার দায় স্বীকার করা জবানবন্দিতে উঠে আসে তিন বন্ধুর ভয়ংকর খুনি হয়ে ওঠার গল্প। টাকা আয়ের নেশাই তাদের এমন অপরাধের পথে নামিয়েছে বলে আদালতকে জানায় তারা। দ্রুত টাকা আয়ের নেশা চাপে তাদের। ১৫ দিনের ব্যবধানে দুই অটোরিকশাচালককে খুন ও অপর এক চালককে হত্যার চেষ্টা চালান এই তিন বন্ধু। পুলিশের জেরায় তারা বলেছে, রাসেল, তুষার আর বকুল তিনজনই ভারতীয় টিভি সিরিয়াল ক্রাইম প্যাট্রল দেখে অটোরিকশা ছিনতাই করার পরিকল্পনা করেন। জিজ্ঞাসাবাদের সময় তারা স্বীকার করেছেন, দ্রুত টাকা-পায়সার মালিক হতে চান তারা। নিজেরা কেন পরের অটোরিকশা ভাড়ায় চালাবেন। নিজেরাই হবেন অটোরিকশার মালিক। এই চিন্তা থেকেই তারা ২৭ মার্চ প্রথম অটোরিকশাচালক জাকিরকে ধারালো চাকু দিয়ে হত্যা করে অটোরিকশা ছিনিয়ে নেন। এরপর ২ এপ্রিল অপর অটোরিকশাচালক মতিউরকে খুন করেন। সব কটি ঘটনাই ছিল ক্লুলেস। সর্বশেষ ১১ এপ্রিল সাভারের মাইনুলকে গুরুতর জখম করে অটোরিকশা ছিনিয়ে নেয় এই তিন বন্ধু। এ ঘটনার সূত্র ধরে দুই অটোরিকশাচালক খুনের রহস্য বেরিয়ে আসে। জিজ্ঞাসাবাদের সময় তুষার জানায়, কেরানীগঞ্জের জাকির এবং সাভারের মতিউর খুনে তারা তিন বন্ধু জড়িত। এরপর সিরাজগঞ্জ থেকে বকুলকে গ্রেফতার করা হয়। আর বগুড়া থেকে গ্রেফতার করা হয় রাসেলকে। দুজন নিরীহ অটোরিকশাচালককে খুন ও একজন চালককে হত্যার চেষ্টা চালায় ওই তিন বন্ধু। অটোরিকশা বিক্রি করে দিয়ে তারা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। রাতের অন্ধকারে খুনের ঘটনাগুলো ঘটিয়ে তাদের ধারণা জন্মেছিল, তারা হয়তো ধরা পড়বেন না। কিন্তু অপরাধ করে কখনো পার পাওয়া যায় না।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর