সোমবার, ২৮ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

সেই সীতাকোট বৌদ্ধবিহার এখন

রিয়াজুল ইসলাম, দিনাজপুর

সেই সীতাকোট বৌদ্ধবিহার এখন

প্রাচীন প্রত্নকীর্তি ঐতিহাসিক সীতাকোট বৌদ্ধবিহার পৌরাণিক কাহিনির জেলা দিনাজপুরের নবাবগঞ্জের একাধিক ঐতিহাসিক স্থান ও নিদর্শনের মধ্যে একটি। বর্তমানে সংরক্ষণের অভাবে এর বেহাল দশা।

সীতাকোট বৌদ্ধবিহার অবহেলা আর দেখভালের অভাবে চারণভূমিতে পরিণত হয়েছে। প্রাচীন এ ঐতিহ্য ধরে রাখতে প্রত্নকীর্তিটির সংস্কার জরুরি। এতে একদিকে ঐতিহ্যকে যেমন ধরে রাখা যাবে, অন্যদিকে আরও পর্যটক আকৃষ্ট হবে। দিনাজপুর জেলা সদর থেকে ৬০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে, বিরামপুর থেকে ৪ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে এবং নবাবগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে ২ কিলোমিটার পশ্চিমে বিরামপুরগামী পাকা রাস্তার উত্তর পাশে গোলাপগঞ্জ ইউপির ফতেপুর মাড়াসপুর গ্রামে প্রত্নকীর্তি সীতাকোট বৌদ্ধবিহার। এটি প্রায় ১ একর আয়তনবিশিষ্ট ভূমির ওপর অবস্থিত।

জনশ্রুতি ছিল, রামের স্ত্রী সীতা দীর্ঘদিন এ স্থানে বনবাসে ছিলেন বলে এর নাম হয়েছে সীতাকোট। আবার কেউ কেউ একে বলেন সীতাকুঠুরি। প্রকৃতপক্ষে এটি একটি বৌদ্ধবিহার।

দিনাজপুর জেলা পরিষদের উদ্যোগে ১৯৬৮ ও ১৯৭২ সালে দুই দফায় আংশিক খননের পর দেখা গেল, এটি সীতার কুঠুরি ছিল না, এটি আসলে ছিল একটি প্রচীন বৌদ্ধবিহার। এ বিহার পূর্ব-পশ্চিমে দৈর্ঘ্যে ২১৪ ফুট, উত্তর-দক্ষিণে প্রস্থে ২১২ ফুট। শৌচাগার ছাড়া ছোট-বড় কক্ষের সংখ্যা ৪১টি। কক্ষে প্রবেশের পথ ৩ থেকে ৫ ফুট প্রশস্ত। এর মূল প্রবেশপথ          উত্তর দিকে। বিহারের ভিতরে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে একটি কূপ ছিল। বর্তমানে এটি ভরাট হয়ে গেছে। বিহারের বাইরে পূর্ব-দক্ষিণে পাঁচটি কুঠুরি দেখা যায়। মূল মন্দির ছিল দক্ষিণ দিকের মাঝের স্থানে। প্রতিটি কক্ষে প্রবেশের জন্য একটিমাত্র পথ আছে। পশ্চিম দিকে মাঝের অংশে একটি বড় কক্ষ, এর দক্ষিণ পাশের কক্ষটি খুব ছোট। এর কোনো প্রবেশপথ নেই। সম্ভবত এটি গুপ্তকক্ষ ছিল। সমগ্র ইমারতের গাঁথুনি চুন-সুরকি দিয়ে গঠিত। লম্বা, মধ্যম ও ছোট তিন ধরনের ইট দেখা যায় এতে। বিহারটিতে রয়েছে দুটি ছোট ব্রোঞ্জের মূর্তি- একটি লোকেশ্বর ও অপরটি মঞ্জুশ্রী। এ ছাড়া বিভিন্ন নকশার মাছ, ইট, হাঁড়ি-পাতিলের টুকরা, পেরেক ইত্যাদি পাওয়া যায়। বাংলাদেশে আবিষ্কৃত অন্য সব বিহারের চেয়েও এটি প্রাচীন। বর্তমানে বিহারটি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কিংবদন্তি রয়েছে, রামায়ণে বর্ণিত রাম এখানেই সীতাকে নির্বাসনে দিয়েছিলেন। তবে এসব বহু লোককথা সীতাকোট বিহারকে নিয়ে থাকলেও প্রকৃত ইতিহাস থেকে জানা যায়, আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে ভারতীয় উপমহাদেশে বিখ্যাত গুপ্ত বংশের সম্রাটরা রাজত্ব করতেন। এ দেশে খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতকের তৃতীয় ভাগে সমুদ্র গুপ্তের আমলে গুপ্ত বংশের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত এ দেশে এই বংশের শাসন চলে। ওই আমলে এ দেশে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বহু মানুষ বাস করতেন। লেখাপড়া ও জ্ঞানার্জন ছিল তাদের অন্যতম কাজ। সে সময় গড়ে উঠেছিল বড় বড় সব বিদ্যাপীঠ বা জ্ঞানকেন্দ্র। তখনকার সময়ে এসব স্কুল বা জ্ঞানকেন্দ্রকে বলা হতো বিহার। বিহার মানে সেই জায়গা, যেখানে ছাত্ররা বসবাস ও শিক্ষা গ্রহণ করত। যেহেতু তাদের ধর্ম ছিল বৌদ্ধ এবং এখানে বৌদ্ধধর্মীয় জ্ঞানও প্রদান হতো, তাই এগুলোকে বলা হতো বৌদ্ধবিহার। এসব বিহারে পড়ানো হতো চিকিৎসাবিদ্যা, দর্শন, গণিত, রসায়ন, ব্যাকরণ, প্রকৌশল বিদ্যাসহ আধুনিক সব বিষয়। এই বিহারগুলোর কারণেই প্রাচীন বাংলার শিক্ষিত মানুষদের খ্যাতি ছিল বিশ্বজোড়া। তবে এর নির্মাণরীতি দেখে ধারণা করা হয়, এটি খ্রিষ্টীয় সপ্তম-অষ্টম শতকের দিকে নির্মিত হয়েছিল।

সর্বশেষ খবর