মঙ্গলবার, ৬ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

একের পর এক দুর্ঘটনায় দায় কার?

নিজস্ব প্রতিবেদক

একের পর এক দুর্ঘটনায় দায় কার?

রাজধানীর মগবাজারে বিস্ফোরণের নয় দিন পার হলেও এখন পর্যন্ত কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেনি কোনো তদন্ত কমিটি। ঘটনার এত দিন পার হলেও এর জন্য দায়ী কাউকেই গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। এ ঘটনায় বেশ কয়েকটি সংস্থার পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও তারা এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিবেদন জমা দিতে পারেননি। লকডাউনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় কাজের গতি কম বলে তারা জানান। এমনকি মগবাজারের ঘটনায় নিহত ১১ জনের পরিবারের কেউ এ পর্যন্ত পাননি বিশেষ কোনো ক্ষতিপূরণ। এর আগেও বিভিন্ন সময় বিস্ফোরণে মানুষ হতাহত হয়েছে। কিন্তু এসব দুর্ঘটনার দায় কেউ নেয়নি। প্রকৃত অপরাধীকেও শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব হয়নি।

মগবাজারের রাখী ভিলায় বিস্ফোরণের ১০ মাস আগে গত বছর সেপ্টেম্বরে নারায়ণগঞ্জের তল্লার একটি মসজিদে ভয়াবহ বিস্ফোরণে ৩৭ জন মারা যান। তিতাস গ্যাসের ছিদ্র থেকে ওই বিস্ফোরণ বলে জানানো হয়। এর আগে ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার চকবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে মারা যান ৭৩ জন। কিন্তু এ ঘটনায় করা ফৌজদারি মামলার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। জানা যায়নি আগুনের উৎসও।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, এ ধরনের দুর্ঘটনার দায় কেউই নিতে চাইবে না। আবার অনেক ক্ষেত্রে দুর্ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন জমা হলেও গণমাধ্যমে তা আসছে না। তবে এসব দুর্ঘটনায় গঠিত তদন্ত প্রতিবেদনের ফলাফল অবশ্যই জাতির সামনে আসা উচিত। দুর্ঘটনায় মানুষের প্রাণহানি ঘটবে, ধ্বংসযজ্ঞ হবে কিন্তুপ্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি দায় নেবে না তা হতে পারে না।

ফায়ার সার্ভিসের তথ্য-উপাত্ত বলছে, গত বছর দেশে গ্যাসলাইন, গ্যাস সিলিন্ডার ও বয়লার বিস্ফোরণে আগুনের ঘটনা ঘটেছে ৯৫৭টি। মারা গেছেন ১৫৪ জন। এ ছাড়া সড়ক, নৌ, রেল, ভবন, ভূমিধস, বজ্রপাত, গ্যাস সিলিন্ডারসহ বিভিন্ন দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ২ হাজার ২০৮ জন। মগবাজারের রাখী ভিলায় বিস্ফোরণের ঘটনায় পুলিশের পাশাপাশি ফায়ার সার্ভিস ও বিস্ফোরক পরিদফতর, তিতাস কর্তৃপক্ষ এবং পেট্রোবাংলার পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কিন্তু কেউই এখনো প্রতিবেদন জমা দেয়নি। গতকাল দুপুরেও বিস্ফোরণস্থল পরিদর্শন করে পেট্রোবাংলা ও তিতাস গ্যাস কোম্পানি গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিনিধি দল। জানা যায়, মগবাজারের বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটি নির্মাণের নকশা থেকে ১৪ ফুট সামনে বাড়ানো হয়েছে। গ্যাসের পাইপলাইনের যে উৎস পাওয়া গেছে তা ওই ভবনের নিচে শনাক্ত হয়েছে। এ বিষয়টি মাথায় রেখে বিভিন্ন বিভাগের গঠিত তদন্ত কমিটি কাজ করছে। পেট্রোবাংলার তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক জি এম শাহনেওয়াজ পারভেজ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এ দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে আমাদের কমিটি গঠিত হয়েছে ৩ জুলাই। আজ (গতকাল) প্রথম দিন। কী কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে বুঝতে গিয়েছিলাম। এর জন্য গ্যাস না অন্য কিছু দায়ী তা বোঝার চেষ্টা       করছি। এখানে কোনো অবৈধ গ্যাসের লাইন ছিল কি না বা বৈধ গ্যাসলাইন লিক হয়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে কি না বুঝতে গিয়েছিলাম। সব তথ্য একত্র করে আমরা সিদ্ধান্তে আসতে পারব। এর মধ্যে হাতে ১০ দিন আছে।’ তবে তিতাস গ্যাস কোম্পানি এরই মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী আলী ইকবাল মো. নুরুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘আমরা এরই মধ্যে মগবাজার বিস্ফোরণের তদন্ত প্রতিবেদনটি জমা দিয়ে দিয়েছি। পেট্রোবাংলা থেকে আরেকটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবে প্রতিবেদনে ভবনটিতে গ্যাসের কোনো সংযোগ নেই বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ধারণা করছি সেখানে বায়োগ্যাস তথা স্যুয়ারেজের ম্যানহোল ছিল, সেটি উড়ে গেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি সেখানে বায়োগ্যাস বা এলপি গ্যাস যে কোনো একটির বিস্ফোরণ হয়েছে। প্রতিবেদনেও এমনটি উল্লেখ করা হয়েছে।’

এক সপ্তাহের মধ্যে জমা দেওয়ার কথা থাকলেও এখনো প্রতিবেদন জমা দেয়নি বিস্ফোরক পরিদফতরের গঠিত কমিটি। প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘অধিদফতরের গঠিত তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি এখনো প্রতিবেদন জমা দেয়নি। তাদের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। চলমান লকডাউনে অফিস বন্ধ থাকায় কাজের গতি কিছুটা কম।’

ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটির সদস্য ও ঢাকা বিভাগের উপপরিচালক দীনমণি শর্মা শনিবার বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদন এখনো জমা দেওয়া হয়নি। আশা করছি তিন-চার দিনের মধ্যে জমা দিতে পারব। এরই মধ্যে সংশ্লিষ্ট অফিসগুলোয় আমরা তথ্য চেয়েছি। লকডাউনে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় তথ্যগুলো সময়মতো পাচ্ছি না। বিভিন্ন বিষয় এখন বিশ্লেষণ করছি। সর্বশেষ ঢাকা মেডিকেলে একজন দগ্ধ মারা গেছেন। তিনি আঘাত পেয়ে না আগুনের জন্য শ্বাসকষ্টে মারা গেছেন তা বের করতে হবে। আবার রাখী ভিলা কীভাবে বেঙ্গল মিট হয়ে হয়ে গেল তা-ও বের করতে হবে। ভবনটি আবাসিক না বাণিজ্যিক তা বের করতে হবে। এখনো এর উত্তর পাওয়া যায়নি।’ এরই মধ্যে মগবাজার বিস্ফোরণের ঘটনায় ভবন মালিকসহ তিতাস গ্যাস, বিদ্যুৎ সঞ্চালন কোম্পানির ত্রুটিপূর্ণ সংযোগ, সিটি করপোরেশনের অপরিকল্পিত খননকে সন্দেহের তালিকায় রেখে অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগে মামলা করেছে পুলিশ। কিন্তু ঘটনার এত দিন পার হলেও দায়ী কেউই গ্রেফতার হয়নি। এমনকি এ ঘটনায় নিহত ১১ জনের পরিবারের কেউ পায়নি ক্ষতিপূরণ। তদন্তে কোনো অগ্রগতি না থাকায় মামলার তদন্তভার পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটে হস্তান্তর করা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর