শুক্রবার, ৯ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

খুনি তবে কে

মির্জা মেহেদী তমাল

খুনি তবে কে

খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেই নিয়ম করে বাসার সবাইকে জাগিয়ে তুলত সে। চিৎকার-চেঁচামেচি করে তার ডাকাডাকির পর কেউ আর বিছানায় থাকতে পারতেন না। রাজধানীর রামপুরার ৩ নম্বর ডিআইটি রোডের বাড়ির সকালটা শুরু হতো হইচইয়ের মধ্য দিয়েই। এক সকালের রোদ কড়া হতে থাকলেও সেই ‘ঘুম ভাঙানি’র ঘুম ভাঙেনি। সদা হাস্যোজ্জ্বল অষ্টাদশী এই তরুণীর চোখ বাঁধা রক্তাক্ত লাশ মিলল নিজের বেডরুম থেকে। পুলিশ এলো। তদন্ত শুরু হলো।

জানা গেল ধর্ষণের পর শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে মেয়েটিকে। খুনি চক্র প্রভাবশালী হওয়ায় তদন্ত থেমে থেমে চলেছে। সিটি কলেজের মার্কেটিং বিভাগের ছাত্রী রুশদানিয়া বুশরা ইসলাম খুনের ঘটনা এটি। আজ থেকে ২১ বছর আগে তার বয়স ছিল ১৮ বছর। ২০০০ সালের জুলাই মাসে হাসিখুশি এই তরুণীর রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার হয়েছিল নিজের বেডরুম থেকে। রাতভর তাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হলেও বাসার কেউ কিছুটি টের পায়নি। ঘটনার পর খুনিদের গ্রেফতারে যিনি তৎপরতা দেখিয়েছিলেন সবচেয়ে বেশি, বুশরার এক আত্মীয় খুনের ঘটনায় পরে গ্রেফতার হন। বাড়িসহ জমি আত্মসাৎ করতেই এই খুনের ঘটনাটি ঘটে বলে পুলিশি তদন্তে বেরিয়ে আসে। অভিযোগ রয়েছে, তৎকালীন সময়ে তিনি সরকার সমর্থিত একজন নেতা হওয়ায় পুলিশের তদন্ত চলেছে ধীরগতিতে। ওই সময়ে বুশরা খুনের ঘটনাটি আলোচিত হয়ে ওঠে। বিশেষ করে বুশরার খুনি সরকারি দলের নেতা হওয়ায় ঘটনাটি গুরুত্ব পায় বেশি। পত্র-পত্রিকায় বুশরা খুনের ঘটনাটি গুরুত্বসহকারে প্রকাশ হওয়ায় পুলিশ বাধ্য হয়েছিল ওই আত্মীয়কে গ্রেফতার করতে। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান ছিলেন বুশরা। বাবা সিরাজুল ইসলাম ছিলেন সহকারী পুলিশ সুপার। ঘটনার সময়ে তিনি ছিলেন অবসরকালীন ছুটিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। মা লায়লা ইসলাম ছিলেন গৃহিণী। ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলায় তাদের গ্রামের বাড়ি। বুশরা ডিআইটির ওই বাসায় থেকে লেখাপড়া করতেন। মা থাকতেন গ্রামের বাড়ি। ঘটনার কয়েক মাস আগে তারা ঢাকায় চলে আসেন। প্রতিদিন সকাল ৬টায় ঘুম থেকে উঠে অন্যদের জাগাতেন বুশরা। ওই বাসায় তার মা বাদেও থাকতেন তার এক খালা, পরিবারসহ মামা এম এ কাদের। কাদেরের এক শ্যালিকাও থাকতেন ওই বাড়িতে। সেদিন বুশরা কাউকে ঘুম থেকে জাগাননি। কাজের বুয়া সুফিয়া সকাল ৮টায় বুশরাকে ঘুম থেকে জাগানোর জন্য ডাকাডাকি করতে থাকেন। কিন্তু কোনো সাড়া-শব্দ নেই বুশরার। সুফিয়া সেখান থেকে গিয়ে বুশরার মাকে ডেকে আনেন। বুশরার মা দরজার ফাঁক দিয়ে দেখতে পান, খাটের ওপর এলোমেলোভাবে শুইয়ে আছে বুশরা। তার কাপড়-চোপড় খাটের নিচে পড়ে রয়েছে। এ দৃশ্য দেখে অজানা আশঙ্কায় মায়ের বুক কেঁপে ওঠে। তিনি ওই ঘরের পেছন দিকের জানালার কাছে গিয়ে দেখতে পান, গ্রিল গোল করে কাটা। জানালা দিয়ে তিনি ভিতরে বুশরাকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখতে পান। চোখ ছিল কালো কাপড়ে বাঁধা। খবর দেওয়া হয় পুলিশকে। পুলিশ দরজা ভেঙে বুশরার রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করে। পুলিশ নিশ্চিত হন, বুশরাকে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। পরে জানালার গ্রিল কেটে তারা পালিয়ে যায়। যারাই এ খুনের ঘটনায় জড়িত থাকুক, তারা যে বুশরাদের পরিচিত ছিল, এ বিষয়ে পুলিশের আর কোনো সন্দেহ ছিল না। আগে থেকেই ওই বাড়িতে খুনিরা অবস্থান করছিল। রাতের যে কোনো এক সময়ে বুশরার রুমে গিয়ে তারা হত্যাকান্ড ঘটায়।

এ সময় বুশরার মামা তৎকালীন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের ত্রাণ সম্পাদক এম এ কাদের ঘটনাস্থলে আসেন। তিনি তার ভাগ্নি বুশরার খুনিদের গ্রেফতারের জন্য পুলিশকে অনুরোধ করেন। তিনি পুলিশকে খুনিদের গ্রেফতারে নানা পরামর্শ দিতে শুরু করেন। তৎকালীন শাসক দলের মহানগর নেতা হওয়ার কারণে পুলিশও তাকে সমীহ করতে থাকে। কিন্তু বাড়ি ও জমি আত্মসাতের বিষয়টি যখন সামনে চলে আসে, তখন পুলিশের সন্দেহ হয় কাদেরকে নিয়ে। তাকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশের তদন্তে জানা যায়, ৩ নম্বর ডিআইটির ওই বাড়ির মালিক বুশরার আরেক মামা। তারা সপরিবারে আমেরিকা থাকতেন। বুশরা একটি কক্ষে থেকে লেখাপড়া করতেন। বুশরাকেই দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে পারলে বুশরার বাবা-মাও এই বাড়িতে থাকবেন না। এমন চিন্তা থেকেই বুশরাকে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা ঘটায় বলে তদন্তে পুলিশ জানতে পারে। সিটি কলেজের ছাত্রী রুশদানিয়া ইসলাম বুশরাকে ২০০০ সালের ১ জুলাই রাতে পশ্চিম হাজিপাড়ার বাসায় ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। এ মামলায় ২০০৩ সালের ৩০ জুন ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল রায়ে এম এ কাদের, শওকত ও কবিরের মৃত্যুদন্ড এবং রুনু কাদেরের যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেন। প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী না থাকা এবং রাষ্ট্রপক্ষ অভিযুক্তের বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণ করতে না পারায় বুশরা ধর্ষণ ও হত্যা মামলায় সব আসামিকে খালাস দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। এই মামলার প্রধান আসামি এম এ কাদেরকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছিল নিম্ন আদালত ও হাই কোর্ট। কাদেরের স্ত্রী রুনুকে দেওয়া হয়েছির যাবজ্জীবন সাজা। এ অবস্থায় নতুন করে প্রশ্ন ওঠে, বুশরার খুনি তবে কে?

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর