সোমবার, ১২ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

আটকেই থাকে অগ্নিকাণ্ডের বিচার

৯ বছরে শেষ হয়নি তাজরীন ফ্যাশনে ১১২ শ্রমিকের প্রাণহানির মামলা। হদিস নেই টাম্পাকো ফয়েলসে অগ্নিকান্ডের মামলার। মামলা হয় দুর্বল ধারায়। শুধু জিডিতেই শেষ হয় অনেক ঘটনার আইনি প্রক্রিয়া

আরাফাত মুন্না

আটকেই থাকে অগ্নিকাণ্ডের বিচার

২০০৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের বিএসসিআইসি শিল্প এলাকায় কেটিএস টেক্সটাইল এবং গার্মেন্টসে অগ্নিকান্ডে ৫৭ জন শ্রমিক নিহত হন। আহত হন শতাধিক। ওই ঘটনায় অবহেলাজনিত মৃত্যুর দায়ে মামলা হলেও পরবর্তী সময়ে প্রতিষ্ঠানটির মালিকপক্ষকে বাদ দিয়ে আদালতে চার্জশিট দেয় পুলিশ। এখন পর্যন্ত সেই মামলার বিচার শেষ হয়নি। ২০১২ সালে তাজরীন ফ্যাশনে আগুনে ১১২ শ্রমিকদের প্রাণহানির ঘটনায় করা মামলার বিচারও ৯ বছরে শেষ হয়নি। এরপর ২০১৬ সালে টঙ্গীর বিসিক শিল্প এলাকায় টাম্পাকো ফয়েলস কারখানায় আগুনের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় দায়ের হওয়া দুটি মামলার হদিস জানে না সংশ্লিষ্ট থানা।

শুধু এ তিন ঘটনাই নয়, গত ২০ বছরে ঘটে যাওয়া কমপক্ষে ২৭টি বড় আগুনের ঘটনায় এখন পর্যন্ত মারা গেছেন প্রায় তিন হাজার মানুষ। আহত অসংখ্য। এসব ঘটনার অধিকাংশের তদন্তই শেষ হয়নি। হাতে গোনা যে কয়েকটি মামলা তদন্ত শেষে বিচার পর্যায়ে গেছে, সেগুলোর বিচারও আটকে আছে নানা জটিলতায়। এ তো গেল বিচার। জানা গেছে, আগুনের অনেক ঘটনার আইনি প্রক্রিয়া শেষ হয় শুধু সাধারণ ডায়েরিতেই (জিডি)। মামলা পর্যন্ত হয় না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একের পর এক অগ্নিকান্ডে প্রাণহানিতে বিচার না হওয়া এবং অগ্নিকান্ড প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যর্থতা রাষ্ট্রের। দ্রুত বিচারের মাধ্যমে দায়ীদের শাস্তির আওতায় আনা গেলে অগ্নিকান্ড প্রতিরোধের ব্যবস্থাগুলো যথাযথভাবে পালনে আগ্রহী হতেন কারখানা মালিকরা। তখন দুর্ঘটনা হলেও এত হতাহতের ঘটনা ঘটত না। মামলায় দীর্ঘসূত্রতার কারণ হিসেবে আইনজ্ঞরা বলেন, আগুনের ঘটনায় যেসব মামলা দায়ের হয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আইনের যথাযথ ধারায় মামলা দায়ের হয় না। তদন্তের সময়ও দীর্ঘ সময় চলে যায়। অনেক সময়ই এসব ঘটনায় তদন্ত প্রতিবেদনে পুলিশের নানা ধরনের দুর্বলতা প্রকাশ পায়। ফলে বিচার শেষ হতে লম্বা সময় চলে যায়।

বিচারে দীর্ঘসূত্রতা : ২০১২ সালে সাভারের নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন ফ্যাশনে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে ১১২ শ্রমিকের প্রাণহানির ঘটনার পরদিন আশুলিয়া থানার এসআই খায়রুল ইসলাম বাদী হয়ে দন্ডবিধির ৩০৪ ধারায় একটি মামলা করেন। ২০১৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর মামলাটি তদন্তের পর ১৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন সিআইডির পরিদর্শক এ কে এম মহসীনুজ্জামান। অভিযোগপত্রে সাক্ষী করা হয় ১০৪ জনকে। ২০১৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে আদালত। এ মামলার বিচার এখনো সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়েই।

এরপর ২০১৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর টঙ্গীর বিসিক শিল্প এলাকায় টাম্পাকো ফয়েলস কারখানায় আগুনের ঘটনাটিও সে সময় তুমুল আলোচনা তৈরি করে। মারা যান ৪২ জন। এর একটি মামলায় পুলিশ ও অন্যটিতে নিহত এক শ্রমিকের বাবা বাদী হন। পুলিশের করা মামলায় প্রতিষ্ঠানটির মালিক বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য মকবুল হোসেনকে প্রধান আসামি করে ১০ জনকে আসামি করা হয়। ওই মামলার বাদী ছিলেন টঙ্গী থানার এসআই অজয় কুমার চক্রবর্তী। ২০১৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর নিহত শ্রমিক জুয়েলের বাবা আবদুল কাদের অপর মামলাটি করেন। তবে এ মামলা দুটোর সর্বশেষ অবস্থা জানে না সংশ্লিষ্ট থানা।মামলা দুটির বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য জানতে চাইলে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ (জিএমপি) টঙ্গী পূর্ব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাবেদ মাসুদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি নতুন এসেছি। এ ছাড়া গাজীপুর মেট্রোপলিটনও নতুন হয়েছে। জেলার সময়ের মামলার বিষয়ে এখনই কিছু বলতে পারব না।’

গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (অপরাধ দক্ষিণ) মোহাম্মদ ইলতুৎ মিশ বলেন, ‘এ মুহূর্তে ওই মামলা সম্পর্কে কিছু বলা সম্ভব নয়। খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে। মামলার নথি খুঁজে পেলে জানানো যাবে।’

জিডিতেই শেষ আইনি প্রক্রিয়া : নিমতলী ট্র্যাজেডির পর গত ১১ বছরে কোনো নিয়মিত মামলা হয়নি। ঘটনার পর বংশাল থানায় শুধু একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়। এ ডায়েরি ঘিরেও কোনো তদন্ত গত ৯ বছরে হয়নি বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। এ ছাড়া ১৯৯০ সালের ১৭ ডিসেম্বর মিরপুরের সারেকা গার্মেন্টসের অগ্নিকান্ডে ২৭ জন পুড়ে মারা যান। ১৯৯৫ সালে ঢাকার ইব্রাহিমপুরের লুসাকা অ্যাপারেলসে অগ্নিকান্ডে ১০ জন কর্মী প্রাণ হারান। ১৯৯৬ সালে ঢাকার তাহিদুল ফ্যাশনে ১৪ জন এবং সিনটেক্স লিমিটেডের কারখানায় ১৪ জন পুড়ে মারা যান। ১৯৯৭ সালে মিরপুরের তামান্না গার্মেন্টসে ২৭ জন এবং মিরপুর-১ নম্বর মাজার রোডের রহমান অ্যান্ড রহমান অ্যাপারেলসে আগুনে ২২ শ্রমিক মারা যান। ২০০০ সালের ২৫ নভেম্বর নরসিংদীর চৌধুরী নিটওয়্যার লিমিটেডে আগুনে ৫৩ শ্রমিকের প্রাণহানি ঘটে। ২০০০ সালে বনানীর চেয়ারম্যানবাড়িতে গ্লোব নিটিং ফ্যাশন লিমিটেডে ১২ শ্রমিক অগ্নিকান্ডে মারা যান। ২০০১ সালে মিরপুরের মিকো সোয়েটার লিমিটেডে আগুনের গুজবে পদদলিত হয়ে মারা যান ২৪ শ্রমিক। ২০০৫ সালে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে সান নিটিং গার্মেন্টসে আগুনে ২০ শ্রমিক মারা যান। এসব ঘটনায় কোনো মামলা দায়েরের তথ্য পাওয়া যায়নি। প্রতিটি ঘটনায় একটি সাধারণ ডায়েরি হয়। এরপর এসব ঘটনার তদন্ত সেখানেই শেষ হয়।

আইনজ্ঞদের অভিমত : এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, একের পর এক অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটছে। কিন্তু এ ঘটনায় দায়ীদের যথাযথ বিচার হচ্ছে না। এর দায় আসলে রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। তিনি বলেন, মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করে দায়ীদের শাস্তির আওতায় আনা গেলে কারখানা মালিকরা আরও সচেতন হতেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু বলেন, অধিকাংশ সময় দেখা যায়, আগুনের ঘটনায় যে মামলাগুলো হয়, তা সঠিক ধারায় হয় না। অগ্নিকান্ডের সময় গেটে তালা দিয়ে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে, অথচ মামলা হচ্ছে দন্ডবিধির ৩০৪ ধারায়। অর্থাৎ নরহত্যার অভিযোগে। তিনি বলেন, নরহত্যা হচ্ছে সরাসরি খুন নয়, কিন্তু মৃত্যু হতে পারে এমন কাজ করা এবং এতে কারও মৃত্যু হওয়া। এই ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ড। অথচ এসব মামলা দন্ডবিধির ৩০২ ধারায় অর্থাৎ হত্যা মামলা হতে পারত, যার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড।

সর্বশেষ খবর