সোমবার, ১২ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

পাঁচ হাত বদলের পরও মোবাইলেই খুনের ক্লু

মির্জা মেহেদী তমাল

পাঁচ হাত বদলের পরও মোবাইলেই খুনের ক্লু

রাজবাড়ীর পদ্মা নদীর পাড়। নদীর তীর ঘেঁষে চলার পথ। এ পথেই হাটে যায় গ্রামবাসী। শীতের এক সকালে সেই পথেই হাটের দিকে যাচ্ছিল সবাই। নদীর দিকে তাকাতে দৃষ্টি আটকে যায় সবার। আঁতকে ওঠে তারা, পানিতে ভাসছে লাশ। ভাসতে ভাসতে একদম তীরে এসে ঠেকেছে। সামনে গিয়ে ভালো করে দেখে নেয় লোকজন। কেউ চিনতে পারে না। লাশ ভাসছে- এমন খবর চাউর হয়ে যায় কাছাকাছি সব এলাকায়। লোকজন ছুটে আসতে থাকে। খবর পেয়ে পুলিশ আসে। লাশ উদ্ধারের সময় স্থানীয় এক রিকশাচালক কান্না করতে করতে হাজির। তিনি পুলিশকে জানান, লাশটি তার একমাত্র ছেলে লিটুর, সে আড়তে কাজ করত। আড়তের মহাজন অত্যন্ত ভালো মানুষ। ছেলের মতো করে দেখতেন লিটুকে, থাকত মালিকের বাসাতেই। ঘটনাটি ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসের।

রাজবাড়ী থানা পুলিশ তদন্ত শুরু করে। লিটু যে আড়তে কাজ করত সেই মালিককে থানায় ধরে নিয়ে আসে পুলিশ। তার জেরা চলে। আড়তদার বারেক পুলিশকে জানান, লিটুকে তিনি ছেলের মতো দেখতেন। বিশ্বাসী ছিল বলে তাকে নিজ বাসাতেই থাকতে দিয়েছেন। সেই সকালে ঘুম থেকে উঠে তিনি আর লিটুকে বাসায় দেখেননি। তিনি ভেবেছিলেন লিটু আড়তে চলে গেছে। কিন্তু আড়তে গিয়ে লিটুকে দেখতে পাননি। এর কিছু পরই তার মোবাইল ফোনে খবর আসে, লিটুর লাশ পাওয়া গেছে পদ্মার তীরে।

পুলিশ তদন্ত শুরু করলেও লিটুর নাম ঠিকানা আর তার পেশা ছাড়া আর কোনো তথ্য সংগ্রহ করতে পারে না। এলাকায় লিটুর কোনো শত্রু বলতে ছিল না। পুলিশ ভীষণ দ্বন্দ্বে পড়ে লিটু খুনের ঘটনাটি নিয়ে। খুনিরা লিটুকে হত্যা করে তার মোবাইল ফোনও নিয়ে গেছে। পুলিশ মাঝে মধ্যে  সেই ফোনে কল দেয় কোনো সূত্রের সন্ধানে। কিন্তু সেটিও খুনের পর আর খোলা হয়নি। বন্ধই পায় পুলিশ। দরিদ্র ঘরের সন্তান লিটুর খুনের ঘটনাটি ধীরে ধীরে ধামাচাপা পড়তে থাকে। সবকিছুই ঠিকঠাক চলতে থাকে। শুধু দরিদ্র রিকশাচালক থানা পুলিশ আর আদালতের দ্বারে দ্বারে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে গেছেন। তার ছেলের হত্যার বিচার আর হবে না নিয়তি হিসাবেই মেনে নিয়েছেন। একটা সময়ে পুলিশের তৎপড়তা প্রায় থেমে যায়। লিটুকেও ভুলতে বসেছে তার পরিচিতজনেরা। আড়তদার বারেকও ভুলে গেছে লিটুকে। এভাবেই পেরিয়ে যায় এক বছর। কিন্তু সন্তানহারা পিতা বৃদ্ধ রিকশাচালক ভুলে না তার সন্তানকে। তিনি থানার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। দেখা করার চেষ্টা করেন পুলিশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে। কিন্তু পারেন না। এক দিন সকালে বাসা থেকে বেরুনোর সময় লিটুর বাবা প্রতিজ্ঞা করেছেন, যেভাবেই হোক পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করবেন। তিনি থানার সামনে গিয়ে ওসির রুমে ঢুকতে চান। কিন্তু দরোজার সামনেই তাকে বাধা দেন পুলিশের এক সদস্য। অসহায় পিতা তখন কান্না করতে থাকেন। চিৎকার করে বলতে থাকেন, গরিব বলে আমরা কি বিচার পাব না? বৃদ্ধ রিকশাচালকের গলার আওয়াজ পেয়ে রাজবাড়ী থানার ওসি বেরিয়ে আসেন নিজের রুম থেকে। তিনি বৃদ্ধকে রুমে নিয়ে চিৎকারের কারণ জানতে চান। বৃদ্ধ তখন তার পুত্র লিটুর কথা মনে করিয়ে দেন। ওসির মনে পড়ে লিটু খুনের ঘটনাটি। তিনি বৃদ্ধকে চলে যেতে বলেন। বৃদ্ধকে দেখে পুলিশ কর্মকর্তা খুনের ঘটনাটি আবারো তদন্তের সিদ্ধান্ত নেন। খুনের এক বছর পরে পুলিশ আবারো মাঠে নামে খুনিদের শনাক্ত করতে। পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তা প্রথমেই লিটুর বন্ধ থাকা মোবাইল ফোনে কল দেয়। একি ফোন খোলা! পুলিশ আবারো ফোন দিলে ওপর প্রান্ত থেকে একজন ফোন ধরেন। নিজেকে খোকন বলে পরিচয় দেয়। পুলিশ এবার তার অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হন। তখনই রাজবাড়ী শহরে একটি ভাঙাড়ি দোকানে হানা দিয়ে খোকনকে গ্রেফতার করে। পুলিশ নিশ্চিত এক বছর পরে হলেও খুনের আসামি ধরা পড়েছে। তুই লিটুকে কেন খুন করেছিস? জিজ্ঞাসাবাদের শুরুতেই পুলিশের এমন প্রশ্নে ঘাবড়ে যায় খোকন। পুলিশকে সে জানায়, লিটু খুনের বিষয়ে সে কিছুই জানে না। তবে লিটুর এই ফোনটি কোথায় পেলি? এমন প্রশ্নের জবাবে খোকন বলে, ভাঙাড়ি হিসেবে সে এই মোবাইলটি কিনেছে সিমসহ। কার কাছ থেকে কিনেছিস ফোনটি? জানতে চায় তদন্ত দল। খোকন জানায়, ফোনটি মিরাজের। তার কাছ থেকে কিনেছেন। পুলিশ ছুটে চলে মিরাজের কাছে। ধরে নিয়ে আসে থানায়। মিরাজ পুলিশকে বলে, ফোনটি তিনি পেয়েছেন মজনু নামের একজনের কাছ থেকে। পুলিশ ছুটে যায় মজনুর বাসায়। থানায় এনে চলে জেরা। কিন্তু মজনু বলে, ফোনটি তার নয়। তিনি পেয়েছেন নয়ন নামে তার এক বন্ধুর কাছ থেকে। পুলিশ এবার যায় নয়নের কাছে। এই নয়নকে ধরতেই পুলিশকে পাগলের ছদ্মবেশও নিতে হয়। নয়ন আর লিটু এক আড়তেই কাজ করত। পুলিশ নিশ্চিত হয়, খুনের রহস্য উদঘাটনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে তারা। খুনিরা এখন তাদের কব্জায়।

পুলিশ তদন্তে জানতে পারে, নয়নসহ আরও কয়েক কর্মীর চাকরি চলে যায় চুরির অভিযোগে। আর তাদের চুরিটিও ধরেছিল লিটু। তার মালিককে বলে দেওয়ায় তাদের সবার চাকরি চলে যায়। এ কারণেই প্রতিশোধ নিতে লিটুকে তারা হত্যা করে। জিজ্ঞাসাবাদে নয়ন ও অন্যরাও স্বীকার করে নেয় খুনের ঘটনায় তারা জড়িত। তাদের জেরা করার সময় প্রশ্ন রেখেছিলেন পুলিশের এক কর্মকর্তা, ‘এই তুচ্ছ কারণে তোরা লিটুকে হত্যা করে ফেললি। হত্যা করে নদীতেও লাশ ভাসিয়ে দিয়েছিস।’ এসব শুনে নয়ন মাথা নিচু করে থাকে। এক সময় পুলিশকে বলে, স্যার এই মোবাইলটি দিয়েছিল আমাকে ফিরোজ। এই ফিরোজই আমাদের ৭ হাজার টাকায় ভাড়া করেছিল লিটুকে খুন করার জন্য। তবে আমাদের প্রত্যেকের ভাগে পড়ে ৬০০ টাকা।’ পুলিশ এবার নড়েচড়ে বসে। বলে কী? শেষ মুহূর্তে নতুন তথ্য। নয়নের কাছ থেকে পুলিশ ফিরোজের নাম ঠিকানা নিয়ে অভিযান চালায় ফিরোজের বাসায়। কল্পনাতেও ছিল ফিরোজের যে, লিটু খুনে সে গ্রেফতার হবে। পুলিশ ফিরোজকে নিয়ে সোজা থানায়। ফিরোজ একটা পর্যায়ে খুনের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করে নেয়। ফিরোজ বলে, আড়তের মালিক বারেকের স্ত্রীর সঙ্গে ছিল তার পরকীয়া প্রেম। লিটু এক দিন বাজার দিতে এসে তাকে আর বারেকের স্ত্রীকে এক সঙ্গে দেখে ফেলে। সেদিনই লিটু তার মালিক বারেকের কাছে জানিয়ে দেয়। এ নিয়ে বারেক তার স্ত্রীকে বকাঝকা করে। মনোমালিন্যর সৃষ্টি হয়। বারেকের স্ত্রী নিশ্চিত হয়, লিটু সব বলে দিয়েছে তার স্বামীর কাছে। এটি ফিরোজকে জানায় বারেকের স্ত্রী। ফিরোজ তখন লিটুকে খুন করার পরিকল্পনা আঁটে। আগে থেকেই ফিরোজ জানত যে, আড়তের চাকরিচ্যুত কর্মচারী নয়নসহ অন্যদের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ লিটুর। এই সুযোগটি ফিরোজ লুফে নেয়। নয়নের কাছে গিয়ে তাদের শুধু লিটুকে হত্যা করার প্রস্তাব দেয়। বিনিময়ে তাদের ৭ হাজার টাকা দেওয়া হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয় ফিরোজ। নয়ন তার বন্ধুরা মিলে আড়তে গিয়ে লিটুকে ডেকে নিয়ে যায় পদ্মার পাড়ে। সেখানেই তারা তাকে কুপিয়ে হত্যা করে।

সর্বশেষ খবর