সোমবার, ১২ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

উপহারের ঘর নিয়ে অভিযোগের পাহাড়

নিজস্ব প্রতিবেদক ও জেলা প্রতিনিধি

উপহারের ঘর নিয়ে অভিযোগের পাহাড়

ভূমিহীনদের জন্য নির্মিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহারের ঘর তৈরিতে নিম্নমানের কাজ ও অনিয়ম নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই। নির্মাণের কিছুদিনের মধ্যেই ফাটল দেখা দিয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাটের আশ্রায়ণ প্রকল্পে। বরগুনার আমতলীতে ভিম ছাড়া ঘর নির্মাণ করায় হস্তান্তরের দুই মাসের মধ্যেই দরজা জানালা ভেঙে গেছে । নিম্নমানের কাজ করায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় ঘর তৈরির কাজ বন্ধ করে দিয়েছে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন। সাতক্ষীরার কলারোয়ায় সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) অনিয়ম ঢাকতে আশ্রয়ণ প্রকল্পের সাতটি ঘর রাতের আঁধারে ভেঙে দিয়েছেন বর্তমান ইউএনও। পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীতে পাওয়া গেছে ঘরের নকশা পরিবর্তনের অভিযোগ। বাংলাদেশ প্রতিদিনের সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিরা এসব সংবাদ পাঠিয়েছেন।

বরিশাল থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার রহমতপুরে উপহারের ঘরে ফাটল ধরায় দেয়াল ভেঙে আবার দ্রুত নির্মাণ করা হচ্ছে। আরেকটি ঘরের দুটি খুঁটিতে ফাটল ধরায় মেরামত করা হয়েছে। রহমতপুরে ৪২টি ঘরের অর্ধেকের বেশির ফ্লোরে আস্তরন উঠে গেছে। উপজেলার চাঁদপাশায় নির্মিত ঘরগুলোর বারান্দাও বড় জোয়ার এবং প্লাবনে তলিয়ে যাচ্ছে। উপজেলা প্রশাসন জানিয়েছে, দুই দফায় বাবুগঞ্জ উপজেলায় প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর পেয়েছে ১৮০টি পরিবার। চাঁদপাশা ইউনিয়নের নোমোরহাট এলাকায় নির্মিত ঘরগুলোর মেঝে জোয়ার এবং প্লাবনের পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। বাবুগঞ্জের ইউএনও আমিনুল ইসলাম বলেন, এক উপকারভোগী শক্তি দেখাতে গিয়ে আঘাত করে একটি ঘরের দুটি খুঁটি ভেঙে ফেলেছে। দুই দফায় বরিশাল জেলার ১০ উপজেলায় ১ হাজার ৭৭৪ পরিবারকে জমিসহ ঘর দেওয়া হয়েছে। আরও ২১৮টি ঘর নির্মাণাধীন আছে।

ভোলাহাটে ঘরে ফাটল : চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, ভোলাহাটে আশ্রায়ণ প্রকল্পে ঘর নির্মাণে অনিয়মের কারণে ফাটল দেখা দিয়েছে। যে কোনো বৈরী আবহাওয়ায় তা ধসে পড়ার আশঙ্কা আছে। নির্মাণ কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে নিম্নমানের ইট। টিনশেড করতে ব্যবহার হচ্ছে নিম্নমানের কাঠ। অধিকাংশ ঘরের চাল দিয়ে পানি পড়ছে। পলিথিন দিয়ে পানি আটকানোর চেষ্টা করছেন অনেকেই। ভোলাহাট উপজেলায় প্রথম পর্যায়ে ১৬০, দ্বিতীয় পর্যায়ে ৪১১টি ও তৃতীয় পর্যায়ে ৪০০টি বাড়ি বরাদ্দ হয়েছে।

আখাউড়ায় নির্মাণ কাজ বন্ধ : ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি জানান, আখাউড়ায় ঘর তৈরিতে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করায় কাজ বন্ধ করে দিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। আখাউড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার রোমানা আক্তার উপজেলার উত্তর ইউনিয়নের আজমপুর গ্রামে প্রকল্প পরিদর্শনে গিয়ে অনিয়ম ও নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে ঘর নির্মাণ করায় নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেন। আখাউড়া উত্তর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল হান্নান ভূইয়া স্বপন নির্মাণ কাজে নিম্নমানের ইট আনার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, সেগুলো সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

আমতলীতে ব্যাপক অনিয়ম : বরগুনার আমতলীর আশ্রায়ণ প্রকল্পের ঘর ধসে পড়ার আশঙ্কায় বসবাস করছেন না বরাদ্দপ্রাপ্তরা। হস্তান্তরের দুই মাসের মধ্যে ভিম ছাড়া নির্মাণকরা ঘরগুলোর দরজা জানালা ভেঙে যাচ্ছে। উঠে যাচ্ছে মেঝের পলেস্তারা। ফাটল ধরেছে মূল ভবনে। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মফিজুল ইসলাম বলেন, ঘর নির্মাণের বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। আমাকে ইউএনও হস্তক্ষেপ করতে দেয়নি। তার কার্যালয়ের এনামুল হক বাদশাকে দিয়ে মালামাল ক্রয় ও ঘর নির্মাণসহ সব কাজ করেছেন। শুরুতেই আমি ঘর নির্মাণে অনিয়মের প্রতিবাদ করেছিলাম। কিন্তু এতে ইউএনও আমাকে লাঞ্ছিত করেছেন। ইউএনও আসাদুজ্জামান ঘর নির্মাণে অনিয়মের কথা অস্বীকার করে বলেন, যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করে কাজ করা হচ্ছে।

কলারোয়ায় ঘর ভেঙে দিলেন ইউএনও : সাবেক ইউএনওর দুর্নীতি ঢাকতে আশ্রয়ণ প্রকল্পের সাতটি ঘর রাতের আঁধারে ভেঙে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিলেন সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার বর্তমান ইউএনও। প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া ঘর নির্মাণের নানা ত্রুটি নিয়ে দুর্নীতির তদন্ত শুরু হয়। সদ্য বিদায়ী ইউএনও মৌসুমি জেরিনকে রক্ষা করতেই এই ঘর ভাঙা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা। উপজেলার লাঙ্গলঝাড়া ইউনিয়নের তৈলকুপি গ্রামে ঘরগুলো ভাঙা হয়। স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম লাল্টু জানান, নির্মাণ কাজে ত্রুটির কারণে অল্প দিনের মধ্যেই ঘরগুলো ফাটল ও ধসে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। ইউএনও বলেন, সাতটি ঘর ভেঙে ফেলা হয়েছে। ঝুঁকির বিষয়টি বিবেচনা করে উপজেলা চেয়ারম্যান ও স্থানীয় এমপিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পরামর্শে ঘরগুলো ভাঙা হয়েছে।

গলাচিপায় নকশা পরিবর্তন : গলাচিপা (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি জানান, রাঙ্গাবালী উপজেলার আমলিবাড়িয়ায় নকশা পরিবর্তন করে ঘর তৈরি করা হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা বলেন, বলা হয়েছে, নকশার পরিবর্তন করা যাবে না। কেউ পরিবর্তন করে থাকলে আমরা তদন্ত করে দেখব।

নওগাঁয় দেড় হাজার পরিবারের মাথা গোঁজার ঠাঁই : নওগাঁ প্রতিনিধি জানান, আশ্রায়ণ প্রকল্পের আওতায় প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে নওগাঁয় আরও ১ হাজার ৫৫৮টি গৃহহীন পরিবার ঘর পেয়ে সুন্দরভাবে জীবনযাপন করছেন। মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় জেলার ১১টি উপজেলায় এসব গৃহহীন পরিবার ঘর বরাদ্দ পেয়েছেন। প্রতিটি ঘরে দুটি কক্ষ, টয়লেট, রান্নাঘর, কমনস্পেস, একটি বারান্দা ও বিদ্যুৎ এবং পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে কয়েকটি ঘরের ফাটল ও মেঝের আস্তরণ উঠে যাওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বলছেন, নিচু জমি ভরাট করে নতুন মাটিতে ঘর নির্মাণ ও বর্ষার কারণে দুই একটি ঘরে এই সমস্যা দেখা গেছে। এসব শোনার সঙ্গে সঙ্গেই ঘর মেরামত করে দেওয়া হয়েছে।

জেলা প্রশাসক হারুন-অর-রশীদ জানান, জেলায় প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে ১ হাজার ৫৫৮ জন পরিবারকে ২ শতাংশ খাস জমি বন্দোবস্ত পূর্বক, কবুলিয়ত ও নামজারিসহ এসব ঘর হস্তান্তর করা হয়েছে। ঘর নির্মাণে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে মাঠপর্যায়ে সরকারের কর্মকর্তারা নিরলসভাবে কাজ করেছেন। নিচু জমি ভরাট করে নতুন মাটিতে ঘর নির্মাণ ও বর্ষার কারণে দু-একটি ঘরে সামান্য সমস্যা দেখা গেছে। ইতিমধ্যে আমি নিজেও ঘরগুলো পরিদর্শন করেছি।

মুরাদনগরে ৯টি ঘরের বারান্দা ভেঙেছে : কুমিল্লা প্রতিনিধি জানান, কুমিল্লার মুরাদনগরে নির্মিত ৯টি ঘরের বারান্দা আংশিক ভেঙে পড়েছে বলে জানা গেছে। ঝুঁকিতে আছে আরও কয়েকটি ঘর। উপজেলার চাপিতলা এলাকায় গত সপ্তাহে যে ৯টি ঘর ধসে পড়ে। সেখানে ৩০টি আধাপাকা ঘর তৈরি করা হয়। তড়িঘড়ি করে ড্রেজার দিয়ে মাটি ভরাট করায় চার দিকের মাটির সমন্বয় হয়নি। তাই মাটি ধসে পড়েছে। তাছাড়া নিম্নমানের ইট, রডসহ বিভিন্ন নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছে বলেও স্থানীয়দের অভিযোগ।

চাপিতলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কাইয়ুম ভুইয়া বলেন, ড্রেজারের বালু দিয়ে জমি ভরাট করায় কিছু ঘর ভেঙে গেছে। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আবদুল হাই বলেন, ঘর ধসে পড়েনি। বর্ষণে আংশিক ক্ষতি হয়েছে। মুরাদনগরের ইউএনও অভিষেক দাশ বলেন, আমরা এখনো ঘরগুলো বুঝিয়ে দেইনি। মাটি ধসে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দিয়েছি।

সর্বশেষ খবর