সোমবার, ১২ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

মামা-ভাগ্নের মানব পাচার সিন্ডিকেট

নিজস্ব প্রতিবেদক

দুবাইতে মামা রুবেল। দেশে তারই ভাগ্নে আশিক ওরফে ইউরো আশিক। মানব পাচারের এই মামা-ভাগ্নে সিন্ডিকেটের ২০-২৫ সদস্যের মধ্যে অনেকেই তাদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন। সমুদ্রপথে লিবিয়া পাচারের নামে এই সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। গত দুই বছরে ৮০ বাংলাদেশিকে ইউরোপে পাচার করেছে তারা। তাদের ফাঁদে পা দিয়ে নিখোঁজ হয়েছেন অন্তত ১৪ জন। এই চক্রের বিরুদ্ধে একের পর এক প্রতারণার অভিযোগে গত শনিবার থেকে মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জ এবং ঢাকার কেরানীগঞ্জ ও যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে অভিযান চালিয়ে আটজনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। গ্রেফতাররা হলেন- মো. আশিক (২৫), আজিজুল হক (৩৫), মিজানুর রহমান  মিজান (৪৩), নাজমুল হুদা (৩১), সিমা আক্তার (২৩), হেলেনা বেগম (৪২) ও পলি আক্তার। এ সময় তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ১৭টি পাসপোর্ট, ১৪টি বিভিন্ন ব্যাংকের চেক বই, দুটি এটিএম কার্ড, ১৫টি বিভিন্ন ব্যাংকে টাকা জমাদানের বই, দুটি হিসাব নথি, দুটি এনআইডি, ১০টি মোবাইল ফোন ও নগদ ৫৬ হাজার টাকা।

গতকাল দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই র‌্যাব সদর দফতরের গোয়েন্দা বিভাগ এবং র‌্যাব-৮-এর যৌথ অভিযানে আটজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বিদেশে কর্মসংস্থানের প্রলোভন দেখিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সংঘবদ্ধ এই মানব পাচার চক্রটি বিদেশি চক্রের সঙ্গে অবৈধভাবে ইউরোপে মানব পাচার করে আসছে। তিন ধাপে এ সিন্ডিকেট মানব পাচারের কাজ করে আসছিল।

তিনি আরও বলেন, চক্রটির মাদারীপুর, শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জ ও ফরিদপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ, নোয়াখালী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নিজস্ব এজেন্ট রয়েছে। প্রধান সমন্বয়ক আশিক আত্মীয়স্বজনদের মাধ্যমে মানব পাচারের বিভিন্ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করত। ভূমধ্যসাগর হয়ে ইউরোপে মানব পাচারের আন্তর্জাতিক চক্রের বাংলাদেশি এজেন্ট রুবেল সিন্ডিকেটের বাংলাদেশে প্রধান সমন্বয়ক ‘ইউরো’ আশিক। গত ২৮ ও ২৯ জুন অবৈধভাবে ইউরোপে যাওয়ার সময় ভূমধ্যসাগরের তিউনিশিয়া উপকূলে নৌকা ডুবিতে প্রায় ৪৩ জন নিখোঁজ হয়। তিউনিশিয়ার উপকূলে বিধ্বস্ত নৌকা থেকে ৮৪ জনকে উদ্ধার করা হয়। তার মধ্যে বাংলাদেশ, সুদান, মিসর, ইরিত্রিয়া ও চাদের নাগরিক রয়েছে। গতকাল আরও ৪৯ বাংলাদেশি উদ্ধারের সংবাদ এসেছে।

র‌্যাব বলছে, রুবেল ২০১২-২০১৭ সাল পর্যন্ত লিবিয়া অবস্থানের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মানব পাচার চক্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলে। বর্তমানে লিবিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাসে মানব পাচারের অভিযোগ থাকায় সে দুবাইয়ে অবস্থান করে সিন্ডিকেটটি পরিচালনা করছে। এ চক্রের কেন্দ্রে রয়েছেন রুবেলের স্ত্রী সীমা, রুবেলের ভাগিনা গ্রেফতার আশিক, দুই বোন হেলেনা ও পলি।

কোটি কোটি টাকার লেনদেন : রুবেলের স্ত্রী সীমার অ্যাকাউন্টে দেড় কোটি টাকা ও টালি খাতার তথ্যানুযায়ী আরও এক কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য মিলেছে। বিভিন্ন ব্যাংকে বেশ কয়েকটি অ্যাকাউন্ট আছে বলে জানা গেছে। রুবেলের বোন হেলেনার কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া চেক বইয়ের তথ্যানুযায়ী কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য পেয়েছে র‌্যাব। এ ছাড়াও কয়েকজনের মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবসা রয়েছে।

প্রথমে লিবিয়ায় : চক্রটি বাংলাদেশ থেকে ‘মধ্যপ্রাচ্যের মাধ্যমে লিবিয়া’ রুট ব্যবহার করছিল। মধ্যপ্রাচ্যে বিদেশি এজেন্টদের মাধ্যমে ভিকটিমদের নিয়ে ৭/৮ দিন অবস্থান করত। এই সময়ের ভিতরে লিবিয়ার বেনগাজিতে ভিকটিমদের পাঠানোর জন্য এজেন্টরা ‘মারাকাপা’ নামে একটি ডকুমেন্ট দুবাইয়ে পাঠাত। যা লিবিয়া যাওয়ার আগে দুবাইয়ে অবস্থানরত ভিকটিমদের হস্তান্তর করা হতো। ওই ডকুমেন্টসহ বিদেশি এজেন্টদের সহায়তায় তাদেরকে বেনগাজি পাঠানো হতো। লিবিয়া পর্যন্ত যারা অর্থ পরিশোধ করে তাদের স্বল্প সময়ের মধ্যপ্রাচ্য থেকে সরাসরি লিবিয়ায় পাঠানো হতো। প্রধান অভিযুক্ত রুবেল দুবাই বসে সিন্ডিকেটের সব কার্যক্রম মনিটরিং করে।

লিবিয়া থেকে ইউরোপ : পাচারের শিকারদের ত্রিপলিতে পৌঁছানোর পর লিবিয়ার এজেন্টদের সহায়তায় গাজী, কাজী ও বাবুল নামের তিন বাংলাদেশি তাদের গ্রহণ করত। ভিকটিমদের ত্রিপলিতে কয়েক দিন আটকে রাখা হতো। এ সময়ে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাংলাদেশে অবস্থানরত প্রতিনিধির দ্বারা ভিকটিমদের আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে টাকা আদায় করত। এরপর ইউরোপে পাচারের উদ্দেশ্যে তাদেরকে হস্তান্তর করা হতো। কোনো এক ভোরে কয়েকটি নৌযান লিবিয়া হয়ে তিউনিশিয়া উপকূলীয় চ্যানেল ধরে ঝুঁকিপূর্ণ পথে ইউরোপের দিকে যাত্রা করত। গ্রেফতাররা জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, ভূমধ্যসাগরে বিগত কয়েকটি নৌকাডুবি ও গুলি করে হত্যার ঘটনায় নিখোঁজ ও নিহত বাংলাদেশিদের এই চক্র পাচার করেছে। চক্রটির মাধ্যমে ৭০/৮০ জন বাংলাদেশি অবৈধপথে ইউরোপে পাচার হয়েছেন।

সর্বশেষ খবর