শনিবার, ২৪ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

করোনায় উৎকণ্ঠা বাড়াচ্ছে গর্ভবতীর মৃত্যু

টিকার আওতায় আনার সুপারিশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার, এখন পর্যন্ত টিকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেই স্বাস্থ্য অধিদফতরের

জয়শ্রী ভাদুড়ী

করোনায় উৎকণ্ঠা বাড়াচ্ছে গর্ভবতীর মৃত্যু

নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী ডা. জারিন তাসনীম রিমি। তিন দিন জ্বর থাকায় ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। গত বৃহস্পতিবার সকালে করোনা পজিটিভ রিপোর্ট আসে, দুপুরে মারা যান তিনি। করোনাভাইরাসে গর্ভবতী নারীদের মৃৃত্যু উৎকণ্ঠা বাড়াচ্ছে। করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণে মৃত্যুর হার আশংকাজনক হারে বেড়েছে। গর্ভবতী নারীদের টিকা না দেওয়ায় করোনা আক্রান্ত হলে তৈরি হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি। মা ও নবজাতকের মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। গর্ভবতী শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ান এমন মায়েদের টিকা কর্মসূচির আওতার বাইরে রেখেছে বাংলাদেশ। তাদের টিকা দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছেন, সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় গর্ভবতী নারীরাও আক্রান্ত হচ্ছেন। তাদের পরিবার থেকে সুরক্ষিত রাখতে হবে। গর্ভবতী নারীদের টিকা দেওয়ার বিষয় একটি জাতীয় সিদ্ধান্ত। এ ব্যাপারে টিকা বিষয়ক বিশেষ কমিটি নাইট্যাগ (ন্যাশনাল ইমিউনাইজেশন টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজারি গ্রুপ) এখন পর্যন্ত স্বাস্থ্য অধিদফতরকে কোনো পরামর্শ দেয়নি। তাই স্বাস্থ্য অধিদফতর এখনো গর্ভবতী নারীদের টিকা দেওয়ার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, গর্ভবতী নারীদের টিকা দিলে তাদের মৃত্যু ঝুঁকি কমবে। এ ছাড়া একাধিক জার্নালে টিকা দেওয়ার ব্যাপারে বলা হয়েছে। ফাইজার বায়োএনটেক এবং অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার ব্যাপারে বলা হয়েছে গর্ভবতী নারীদের ১৪-২১ সপ্তাহের মধ্যে টিকা দিলে সবচেয়ে ভালো কার্যকারিতা পাওয়া যাবে। শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ান এমন মায়েদের জন্য এ টিকা নিরাপদ বলা হয়েছে।  

সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) বলেছে, গর্ভবতী নারীদের অবশ্যই টিকা নেওয়া উচিত। এতে করোনা ঝুঁকি কমবে। গর্ভাবস্থায় অন্য কোনো সমস্যা থাকলে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে টিকা নিতে পারে। কোনো জটিলতা না থাকলে তাদের অবশ্যই টিকা নেওয়া উচিত। এতে করোনা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমবে এবং মা ও শিশু নিরাপদ থাকবে। কিন্তু বাংলাদেশে গর্ভবতী নারীদের টিকা কর্মসূচির আওতার বাইরে রাখায় ঘটছে মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর ঘটনা।

গত মঙ্গলবার ঈদের আগের দিন করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ডা. হালিমা আকন্দ। তিনি এ বছর ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গাইনি বিভাগে রেসিডেন্ট হিসেবে যোগদান করেছিলেন। গর্ভবতী অবস্থায় করোনা আক্রান্ত হওয়ায় জটিলতায় পড়েন ডা. হালিমা। এ অবস্থায় অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানের জন্ম দেন তিনি। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে শিশুর মৃত্যুর পরে করোনা কেড়ে নেয় মায়ের জীবন।

গত ১৫ জুলাই ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন নবনীতা সরকার (২৬) নামের এক গর্ভবতী নারী। কভিড পজিটিভ গর্ভবতী নারীদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি রেফার্ড করা হয় বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। জানা গেছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে গত সপ্তাহে সাত দিনে  করোনা আক্রান্ত ছয়জন নারী মারা গেছেন, যার মধ্যে চারজন গর্ভবতী ছিলেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউয়ের অ্যানেসথিসিওলজিস্ট ডা. আসাদুল মজিদ নোমান বলেন, ‘এবার আইসিইউতে গর্ভবতী রোগীর মৃত্যু অনেক বেশি। করোনার গত ঢেউতে দুজন গর্ভবতী রোগীর মৃত্যু হয়েছিল, এবার তা অনেক বেড়েছে। এবার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কারণে রোগীর ফুসফুস দ্রুত সংক্রমিত হচ্ছে এবং দ্রুত মারা যাচ্ছে। আইসিইউ থেকে গর্ভবতী নারীদের সুস্থ হওয়ার হার খুব কম।’ চিকিৎসকরা বলছেন, গর্ভাবস্থায় নারীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। তাই যে কোনো ফ্লু বা সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি থাকে। এ ছাড়া গর্ভাবস্থায় নারীদের পায়ে পানি আসা, ব্লাড সুগার বেড়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। গর্ভস্থ শিশুর চাপে ফুসফুসের কার্যক্ষমতা কমে যায়। এ সময় কভিডের মতো শ্বাসতন্ত্রের ইনফেকশন ফুসফুসের ওপর বাড়তি চাপ প্রয়োগ করে পরিস্থিতি মারাত্মক করে তোলে।

মুগদা জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউয়ের অ্যানেসথিসিওলজিস্ট ডা. সুমন অনিরুদ্ধ বলেন, গত তিন সপ্তাহে ২০-২৫ জন গর্ভবতী নারী আইসিইউতে চিকিৎসা নিয়েছেন। গর্ভবতী নারীদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। শিশুর ভালোর জন্য আমরা সব ওষুধ দিতে পারি না। ৩২ সপ্তাহের গর্ভবতী নারীদের সিজার করে শিশুকে বের করে আইসিইউতে চিকিৎসা দিলে ভালো ফল পাওয়া যায়। কিন্তু ২০-২২ সপ্তাহের গর্ভবতী নারীদের চিকিৎসা দিতে অনেক সমস্যা হয়। গর্ভবতী নারীদের মৃত্যুর হার বেশি আর সুস্থ হলেও আইসিইউতে থাকতে হচ্ছে বেশি। তিনি আরও বলেন, তাদের টিকা দেওয়া হলে হয়তো জটিলতা কিছুটা কমত। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ফাইজার, মডার্নার টিকা গর্ভবতী মায়েদের দেওয়া যাবে। আমাদের দেশেও গর্ভবতী নারীদের টিকা দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত।

সর্বশেষ খবর