বুধবার, ২৮ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

খুনি ছিল চেনা

মির্জা মেহেদী তমাল

খুনি ছিল চেনা

ঢাকার বনানী এলাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মিজানুর রহমান। টঙ্গীর গাজীপুরা এলাকার একটি বাড়িতে সপরিবারে ভাড়া থাকতেন। তার দুই ছেলে তৌসিফুল ইসলাম মুন্না আর তামিম। বড় ছেলে মুন্না ঢাকার উত্তরা শাহিন ক্যাডেট স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী। আর তামিম তৃতীয় শ্রেণির। ২০১৯ সালের ১৮ জুলাই সকাল ৭টার দিকে কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বেরিয়ে যান মিজানুর রহমান। এর কিছু সময় পরই মুন্নাকে বাসায় রেখে তামিমকে নিয়ে স্কুলে যান তাদের মা হামিদা আক্তার। বাসার কাছেই স্কুল। বাসায় তখন একা মুন্না। তামিমের স্কুল ছুটি হয় সকাল ১০টায়। পায়ে হাঁটা পথের দূরত্বের স্কুল থেকে তামিমকে নিয়ে ১০ মিনিটের মধ্যেই বাসায় ফিরে আসেন হামিদা আক্তার। হামিদা আক্তার বাসায় ফিরে ঘরের দরজা বাইরে থেকে আটকানো অবস্থায় দেখতে পান। তিনি আঁতকে ওঠেন। কী ব্যাপার! দরজা বাইরে থেকে আটকানো কেন? ঘরে তো মুন্নাকে রেখে গেছেন। অজানা আশঙ্কায় বুক কাঁপে হামিদার। চিৎকার দিয়ে ওঠেন। ‘মুন্না’ বলে চিৎকার করে ডাকতে থাকেন হামিদা। তার চিৎকারে প্রতিবেশীরা ছুটে আসেন। কী ব্যাপার! কী হয়েছে? এমন প্রশ্ন প্রতিবেশীদের। হামিদা আক্তার কান্না করতে করতে মুন্নার কথা বলতে থাকেন। লোকজনের সহায়তায় হামিদা আক্তার ঘরের দরজা খুলে ভিতরে ঢোকেন। মুন্না মুন্না বলে ডাকতে ডাকতে দৌড়ে ছুটে যান বেডরুমে। বেডরুমে ঢুকেই চোখ পড়ে খাটের ওপর। উপুড় হয়ে পড়ে আছে মুন্না। রক্তে ভাসছে খাট। রক্তাক্ত মুন্নাকে দেখেই মা হামিদা আক্তারের গগনবিদারী চিৎকার। জড়িয়ে ধরেন আদরের সন্তান মুন্নাকে। মুন্নার দেহ ওল্টাতেই দেখতে পান তার গলা কাটা। পেটেও গভীর ক্ষত। রক্ত বেরিয়ে খাটের জাজিম তোশক ভিজে আছে। সংবাদ পেয়ে ছুটে আসে মুন্নার বাবা। আসে পুলিশ। লাশ উদ্ধার করে পাঠানো হয় মর্গে। এ ব্যাপারে মুন্নার বাবা মিজান অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে টঙ্গী পূর্ব থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। পুলিশ প্রায় দুই মাস তদন্তকালে সন্দেহভাজন একজনকে আটক করলেও কোনো রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি। পরবর্তীতে পুলিশ হেডকোয়ার্টারের নির্দেশে চাঞ্চল্যকর ও ক্লুলেস এ ঘটনার মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় গাজীপুর পিবিআইকে। পিবিআই তদন্ত শুরু করলেও এর কোনো সুরাহা করতে পারছিল না। খুনিরা গ্রেফতার হবে- এমন আশা নিয়ে মুন্নার বাবা পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ে ঘুরতে থাকে। কিন্তু কোনো আশাই তিনি পান না। পুলিশ তার নিজের মতো করেই তদন্ত চালিয়ে যেতে থাকে। মাসের পর মাস কাটে। বছর গড়ায়। গ্রেফতার হয় না মুন্নার খুনিরা। পুলিশ শনাক্ত করতে পারে না খুনিদের। ঘটনার দুই বছর পর এই খুনের মামলার তদন্তে মোড় নেয়। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআইর) তদন্ত কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর হাফিজুর রহমান তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে দুজনকে গ্রেফতার করে। এরা হলো আনোয়ার ও মোফাজ্জল হোসেন। দুজনই তাদের পরিচিত। তাদের নিবিড়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করার একপর্যায়ে তারা তৌসিফুল ইসলাম মুন্নাকে খুন করার কথা স্বীকার করে। গ্রেফতারের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মুন্নাদের বাসা থেকে লুণ্ঠিত মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতার দুজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করে। ঘটনার প্রায় দুই বছর পর চাঞ্চল্যকর ও ক্লুলেস স্কুলছাত্র তৌসিফুল ইসলাম মুন্না হত্যার রহস্য উন্মোচন হলো। পুলিশ জানায়, বাসায় মুন্নার বাবা ও মায়ের অনুপস্থিতির সুযোগে ওই দুই যুবক সকাল ৯টার দিকে মুন্নাদের বাসায় যায়। তারা মুন্নাকে ডেকে দরজা খুলে প্রবেশ করে এবং ঘর থেকে মোবাইল ও ক্যামেরা লুট করার চেষ্টা করে। এ সময় বাধা দিলে মুন্নার মুখ চেপে ধরে গলা কেটে ও ছুরিকাঘাত করে তাকে খুন করে। পেটে ছুরিকাঘাত করায় মুন্নার নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে যায়। পরে বিভিন্ন মালামাল লুট করে তারা ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়। গ্রেফতাররা জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করে মূলত চুরি করার উদ্দেশ্যে প্রবেশ করলে আসামিদের চিনে ফেলায় ভিকটিম তৌসিফুল ইসলাম মুন্নাকে তারা হত্যা করে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর