সোমবার, ২ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

মুখোশের আড়ালে

মির্জা মেহেদী তমাল

মুখোশের আড়ালে

ইতালি যাবেন ইফতেখারুল ইসলাম। কিন্তু তার মন চায় না। মাত্র দুই বছর হয়েছে বিয়ে করেছেন। এক বছর প্রেম করে বিউটিকে (ছদ্মনাম) বিয়ে করেন তিনি। দুজন দুজনকে ভীষণ ভালোবাসেন।

বিউটিরও মন ভালো না। স্বামী চলে যাবে বিদেশ। শ্বশুরবাড়িতে স্বামী ছাড়া থাকতে হবে তাকে। ভাবতেই তার কান্না পায়। কিন্তু স্বামীকে বাধা দেন না। কারণ তাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই তো ইফতেখার বিদেশ পাড়ি দিচ্ছেন। সেদিন ঢাকা শাহজালাল বিমানবন্দরে স্বামীকে বিদায় জানাতে গিয়ে কান্না ধরে রাখতে পারেননি বিউটি। হাউমাউ করে কেঁদেছেন শত শত মানুষের সামনে। ইফতেখার সেদিন বুঝতে পারেন, বিউটি তাকে কতটুকু ভালোবাসেন। এতদিন ইফতেখার ভেবেছিলেন, তিনি বোধ হয় বিউটির চেয়ে বেশি ভালোবাসেন। কিন্তু না, সেদিন ইফতেখার বুঝতে পারেন, বিউটিও তার মতো করেই তাকে ভালোবাসেন। প্রতিদিনই দীর্ঘ সময় ফোনে কথা বলেন বিউটি আর ইফতেখার। ভালোবাসার কথা। ইতালিতে কী করছে না করছে, জানতে চান বিউটি। ইফতেখার বলে যান। আবার বিউটির খবরও জানতে চান ইফতেখার। বিউটি কথা বলেন প্রাণ খুলে। ভালোই কাটছিল তাদের। আয়-রোজগার কম হয়নি ইফতেখারের। দেশে টাকা পাঠাতেন বিউটির কাছে। কিন্তু বিউটির দুঃখ, তাকে ফোনে কথা বলতে দেখলেই শাশুড়ি ভীষণ ক্ষেপে যান। অকথ্য ভাষায় বকাবাজি করেন। সহ্য করে যান। স্বামীকে জানান না। এভাবেই কাটে প্রথম দুই বছর। শাশুড়ির ভয়ে স্বামীর সঙ্গে কথা বলা কমিয়ে দেন। শাশুড়িও ফোন করে তার স্বামীকে বলেন, কম কথা বলতে। অযথা টাকা  খরচ করে লাভ কী? এমন পরিস্থিতির পর ইফতেখারও ফোন করা কমিয়ে দেন। সময় কাটে না বিউটির। মিরপুরের বাসা থেকে বেরিয়ে বাবার বাড়ি যান। মাঝেমধ্যে শপিং। এই তার জীবন। এক রাতে একটি মিস কলে পরিচয় হয় স্বপন নামে এক যুবকের সঙ্গে। সেই পরিচয়ের সূত্র ধরে রাত-বিরাতে কথা চলে তাদের। ইতালি থেকে ইফতেখার ফোন দিলেও বেশিক্ষণ কথা বলতে চান না বিউটি। টুকটাক কথা বলেই ফোন কেটে দেন। ইফতেখার ভাবে, হয়তো তার মায়ের কারণে বিউটি বেশিক্ষণ কথা বলতে চান না। এদিকে ছেলে বন্ধু স্বপনকে নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়েন বিউটি। দেখা করেন। তারা দুজন দুজনকে ভালোবেসে ফেলেছেন। বিভিন্ন স্থানে গিয়ে তারা মিলিত হন। বিষয়টি বিউটির শ্বশুরবাড়ির লোকজন বুঝতে পারে। এ নিয়ে তাদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ চলছিল। তার স্বামীর কাছেও খবরটি চলে যায়। স্বপনের কাছে চলে যেতে চান বিউটি। স্বপন তাকে বলেন, তার ব্যবসা এখন খারাপ। ভালো হলেই তাকে বিয়ে করবেন। কিন্তু স্বপনকে ছাড়া ভালো লাগে না বিউটির। সেদিন রাতে বাসায় ফেরেননি বিউটি। তার চালচলনে বেপরোয়া ভাব চলে আসে। ইতিমধ্যে ব্যবসার কথা বলে লাখ দুয়েক টাকা নিয়েছেন স্বপন। এ কথা মনে করিয়ে দিয়ে বিউটি বলেন, তোমাকে টাকা দিলাম ব্যবসা করবা বলে। এখন বলছ কেন ব্যবসা খারাপ! স্বপন তাকে বলেন, আরে ২ লাখ টাকায় ব্যবসা ভালো হয় কীভাবে। লাখ বিশেক টাকা হলে ১৫ দিনেই ব্যবসাটা দাঁড় করাতে পারব। এক মাসের মধ্যেই তবে আমরা বিয়ে করতে পারব। স্বপনের এমন প্রস্তাব ভালো লাগে বিউটির। তিনি এক দিন ভাবতে সময় নেন। দুই দিন পর স্বপনকে ফোন দিয়ে একটি রেস্টুরেন্টে আসতে বলেন বিউটি। স্বপন রেস্টুরেন্টে যান। পৌঁছেই দেখেন বিউটি বসে আছেন। হাতে একটি ব্যাগ। স্বপন তার কাছে যেতেই বিউটি বলেন, এই নাও ২০ লাখ টাকা। কিন্তু, এক মাসের মধ্যে আমরা বিয়ে করব। এই কথাটা যেন মনে থাকে। স্বপন যেন আকাশ থেকে পড়লেন। বলেন, আরে জান, কী বলো! এক মাসের মধ্যে আমরা এক সঙ্গে নতুন বাসায় থাকব। তার আগে বিয়ে করব। যাক, অনেক উপকার করলে। ব্যবসাটা এবার দাঁড়িয়ে যাবে। টাকা দেওয়ার পর আরও কয়েক রাত তারা বাইরে কাটান। বিদেশ থেকে ইফতেখার ফোন দেন বিউটিকে। ফোন ধরেন না বিউটি। সাইফুল যা বোঝার বুঝে ফেলেছেন। এক দিন রাতে বিউটি বলে দেন ইফতেখারকে। তিনি স্বপনের সঙ্গে রাতে বাইরে আছেন। তিনি তাকে ডিভোর্স করবেন। এসব কথা শুনে পাঁচ দিনের মধ্যে দেশে ফিরে আসেন ইফতেখার। কিন্তু বাড়িতে বিউটি নেই। বিউটি তার বাবার বাড়ি। ইফতেখারও সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাকে আর ঘরে তুলবেন না। টাকা-পয়সা সবই তার খোয়া গেছে। এত দিনের আয়-রোজগার সবই বিউটির কাছে। টাকার ব্যাপারে কী করবেন বুঝতে পারে না ইফতেখার। এদিকে স্বপনের দুই দিন ধরে কোনো খোঁজ পান না বিউটি। ভীষণ টেনশন হচ্ছিল তার। তার বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে। কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারে না। খোঁজ করতে করতে মোহাম্মদপুরে স্বপনের মেসে যান। ফ্ল্যাট বাসায় মেস করে থাকেন স্বপন। ঠিকানা আজই পেয়েছে এক বন্ধুর কাছ থেকে। মেসে গিয়ে জানতে পারেন স্বপনের আসল খবর। বাড়িওয়ালা জানান, স্বপন একটা প্রতারক। পাঁচ মাসের ভাড়া না দিয়ে ভেগেছেন। আশপাশের দোকানগুলো থেকে বাকি করেছেন অন্তত ১০ হাজার টাকা। তারা বাসায় আসছেন টাকার জন্য। কিন্তু চার দিন আগে থেকেই স্বপন আসা বন্ধ করেছেন। লোকমুখে শুনেছেন স্বপন বিদেশ চলে গেছেন। বিউটি কথাগুলো শুনে নিজ কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। কী করবেন বুঝতে পারছেন না। কান্না করতে করতে বাবার বাসায় ফেরেন। সেই রাতেই একটি ফোন আসে। স্বপন করেছেন ফোন। স্বপন তাকে বলেন, সরি জান, আমি দেশ থেকে চলে এসেছি। অনেক কষ্ট হয়েছে। তুমি টাকাটা না দিলে বিদেশ আসতে পারতাম না। কিছু মনে কর না। পারলে স্বামীর কাছে ফিরে যাও। আমার পক্ষে তোমাকে বিয়ে করার প্রশ্নই ওঠে না। আমি এখন অনেক দূরে। এ কথা বলেই ফোন কেটে দেন স্বপন। বিউটি বুঝতে পারেন, তিনি একজন প্রতারকের খপ্পরে পড়ে সবকিছু হারিয়ে ফেলেছেন। ব্যবসায়ী সাইফুল কবির। বিদেশে লোক পাঠান তিনি। চার সন্তানের জনক সাইফুল কবিরের বাড়ি বরগুনা জেলা সদরের কাগুরা গ্রামে। ঢাকার দনিয়ায় তার নিজের বাড়ি। বনানীতে অফিস। তার পরিচয় হয় সামিনা নামে এক মহিলার সঙ্গে। পরিচয়ের পর ফোনে কথা। এরপর প্রেম ভালোবাসা। প্রেমে এতটাই মশগুল হয়ে পড়েন নিজের স্ত্রী সন্তানদেরও খোঁজখবর নিতে ভুলে যান সাইফুল কবির। তার স্ত্রীও বিষয়টি জানতে পারেন। রাগ করে সন্তানদের নিয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যান। এদিকে নিজের বাড়ি রেখে কাফরুলে বাসা ভাড়া করে সামিনাকে নিয়ে থাকেন সাইফুল কবির। দনিয়ার বাড়িটিও সামিনাকে লিখে দেন। খিলক্ষেতের একটি ওয়ার্কশপের মাটি খুঁড়ে পুলিশ এক ব্যক্তির গলিত লাশ উদ্ধার করে। দুই দিন পর পুলিশ জানতে পারে, লাশটি ব্যবসায়ী সাইফুল কবিরের। সাইফুল কবিরের বাসায় গিয়ে দেখে ঘরে তালা। বাড়িওয়ালা জানান, এই ভাড়াটিয়া সাইফুল কবির নিখোঁজ রয়েছে। তার স্ত্রী কয়েক দিন আগে বিদেশ চলে গেছে। পুলিশ তদন্তে জানতে পারে, ভাড়াটে খুনি দিয়ে সামিনা সাইফুল কবিরকে খুন করিয়েছে। দনিয়ার বাড়িটি ১ কোটি ৩০ লাখ টাকায় বিক্রি করে বিদেশ পালিয়েছে সামিনা। পরে অবশ্য দেশে ফিরে আসলে পুলিশ সামিনাকে গ্রেফতার করে। মুখোশের আড়ালে ভয়ংকর মানুষের ছড়াছড়ি এখন সারা দেশে। মুখোশে ঢাকা এসব মানুষের খপ্পরে পড়ে জীবন হারাচ্ছে কেউ, আবার সব হারিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে অনেকে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লোভে পড়েই মানুষ এদের খপ্পরে পড়ছেন। পরিবার ও জীবনের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে জড়িয়ে পড়ছে এসব মুখোশধারীর সঙ্গে। ইফতেখারের পাল্লায় পড়ে বিউটি হারিয়েছে পরিবার। সাইফুল কবির হারিয়েছেন জীবন। অনিশ্চিত ভবিষ্যতে তার চার সন্তান।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর