বুধবার, ৪ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা
কৃষি

বরগুনায় অসময়ে তরমুজ চাষে সাফল্য

মো. হাসানুর রহমান ঝন্টু, বরগুনা

বরগুনায় অসময়ে তরমুজ চাষে সাফল্য

বরগুনায় অসময়ে পুকুর পাড়ে মাচায় তরমুজ চাষ করে ভাগ্য ফিরেছে কৃষক দম্পতি আবদুল মান্নান ও রোফেজা আক্তারের। সাধারণত শীতকালে বরগুনার বিভিন্ন স্থানে তরমুজ চাষ হয়ে থাকে আর বিক্রি হয় গ্রীষ্মকালে। কিন্তু এই দম্পতি গ্রীষ্মকালে তরমুজ চাষ করে তা বিক্রি করছেন বর্ষাকালে। তাই আর্থিকভাবে সফলতার পাশাপাশি বরগুনায় মাচায় তরমুজ চাষ কৃষকদের জন্য এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন এই দম্পতি। প্রতিদিনই বিভিন্ন স্থান থেকে কৃষক ও সাধারণ মানুষ এই দম্পতির কৃষি খামারে এসে দেখছেন তাদের সাফল্য। অনেকেই আগামীতে এই কৃষক দম্পতির মতো গ্রীষ্মকালীন তরমুজ চাষে আকৃষ্ট হচ্ছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একসময় অন্যের জমিতে বর্গা চাষ করতেন বরগুনার সদর উপজেলার ৮ নম্বর বরগুনা সদর ইউনিয়নের কালিরতবক গ্রামের কৃষক আবদুল মন্নান। তাতে কোনোমতে সংসার চলত। অভাব অনটন লেগেই থাকত সারাক্ষণ। এ বছর শুরুর দিকে কৃষক আ. মান্নান ও তার স্ত্রী কিষানি রোফেজা আক্তার বাড়ির সামনে ৮০ শতাংশ জমিতে প্রথমে পুকুর কেটে মাছ চাষ শুরু করেন। এরপর পুকুরের দুই পাড়ে মাচা করে নেট দিয়ে শুরু করেন গ্রীষ্মকালীন তরমুজ চাষ। প্রজাতী হিসেবে বাছাই করেন উচ্চ ফলনশীল বেঙ্গল টাইগার, জাপানের ক্যারিশমা, থাইল্যান্ডের তানিয়া জাতের তরমুজ। আশানুরূপ ফলনও হয়েছে তাদের। যখন বরগুনার বাজারে কোনো তরমুজ নেই তখন এই দম্পতির চাষ করা তরমুজ বিক্রি হচ্ছে উচ্চ মূল্যে। এতে সৃজনাল তরমুজ চাষের চেয়ে লাভবান হচ্ছেন কয়েক গুণ বেশি।

কৃষক আ. মন্নান বলেন, আমি কৃষি কাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করে আসছি। আমার তেমন পুঁজি না থাকায় এক সময় বিভিন্ন মানুষের জমিতে বর্গা চাষ করতাম। তা দিয়ে যে আয় হতো তাতে সংসার পরিচালনা করা দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। এরপর নিজেই নিজের যেটুকু সম্পদ ছিল তা দিয়ে নিজে বাড়ির সামনে সবজি বাগান এবং ছোট মাছের ঘের করি বছর তিনেক আগে। বছর খানেক পরে অল্প জায়গায় হেচারি করে পোনা উৎপাদন শুরু করি। পোনা উৎপাদনে ব্যাপক সাফল্য পাই। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকাররা এসে আমার হেচারি থেকে পোনা সংগ্রহ করে। সম্প্রতি বাড়ির পাশেই ৮০ শতাংশ জমিতে আমি মাছ চাষের উদ্দেশে একটি ঘের তৈরি করি। ঘেরের পাশে মাচা তৈরি করে গ্রীষ্মকালীন তরমুজ চাষ শুরু করি। এ বছর যা ফলন আশা করেছিলাম তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি ফলন হয়েছে। বাজারে তরমুজের চাহিদা থাকায় দামও পাচ্ছি ভালো।

তিনি আরও বলেন, প্রথম যখন আমি তরমুজ চাষ শুরু করেছিলাম তখন অনেকেই আমাকে পাগল বলেছিল কিন্তু এখন আমি সফলতা পাওয়ায় অনেকেই অসময়ে তরমুজ চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছে। এ বছর অন্যান্য ফসল বাদ দিয়ে শুধু এই তরমুজে আড়াই থেকে ৩ লাখ টাকা আয় হবে ইনশা আল্লাহ।

আ. মান্নানের স্ত্রী রোফেজা আক্তার বলেন, আমি আর আমার স্বামী দুজনে শুরুতে কৃষি কাজ শুরু করি। কিন্তু এখন আমাদের খামারে অনেকেই অস্থায়ী ভিত্তিতে কাজ করছে। তরমুজ চাষের ব্যাপারে যখন আমার স্বামী আমাকে বলেছিলেন আমি তখন কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব না করে সরাসরি তরমুজ চাষ করার জন্য বলি। তারপর থেকেই দুজনের অক্লান্ত পরিশ্রমে আজ আমরা সফলতা পেয়েছি। আমাদের সফলতা দেখে এখন অনেকেই আগ্রহী হয়ে উঠছে।

স্থানীয় কৃষক আয়নাল বলেন, আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম গ্রীষ্মকালীন তরমুজ চাষ প্রায় অসম্ভব। কিন্তু মান্নানের তরমুজ চাষ আমাদের অবাক করে দিয়েছে। আমরা পড়াশোনা শেষ করে এসে কৃষি কাজ করছি। তবুও অসময়ে তরমুজ চাষে আগ্রহী ছিলাম না। কিন্তু মান্নান এর সফলতা আমাদের আগ্রহী করে তুলছে। আমিও আগামীতে এই প্রক্রিয়ায় মাচায় তরমুজ চাষ করব। বরগুনা কাঁচাবাজারে গিয়ে দেখা গেছে, বেশ কয়েকটি দোকানে তরমুজ রয়েছে। পরিমাণে অল্প হলেও সাধারণত এর আগের বছরগুলো এমন সময় বরগুনার বাজারে কোনো তরমুজই চোখে পড়ত না। দোকানির সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান এটা বরগুনা সদর উপজেলার কালিরতবক গ্রামের কৃষক দম্পতির খামারের তরমুজ। অসময়ে তরমুজের চাহিদা কেমন জানতে চাইলে দোকানি সুব্রত বলেন, আমাদের এখানে এখন যে তরমুজ বিক্রি করি সেগুলো সৃজনাল তরমুজের চেয়ে আলাদা। এই তরমুজগুলোর মধ্যে একটার রং হলুদ ও একটা লাল রঙের। দুটো তরমুজেরই চাহিদা রয়েছে ব্যাপক। ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী আমাদের কাছে পর্যাপ্ত মজুদ নেই। কাঁচাবাজারে এক তরমুজ ক্রেতা এ এইচ হৃদয় বলেন, এই সময় তরমুজ দেখে লোভ সামলাতে পারলাম না। তাই দুই ধরনের তরমুজ থেকে দুটি তরমুজ ক্রয় করেছি। তরমুজের দামও আগের তুলনায় তেমন একটা বেশি না, ২০০ থেকে ৩০০ টাকার মধ্যেই তরমুজ বিক্রি হচ্ছে। আমি এর আগেও এই হলুদ তরমুজ ক্রয় করেছিলাম এগুলো খেতেও সুস্বাদু। বরগুনা সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, কৃষক দম্পতির গ্রীষ্মকালীন তরমুজ চাষে সাফল্য দেখে অনেকের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। আমরা কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে সমন্বিত কৃষিতে উৎসাহ দিচ্ছি। করোনাকালীন সময়েও সার্বক্ষণিক মাঠপর্যায়ে উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে কৃষকদের। অসময়ে তরমুজ চাষের বিষয়টি জানতে পেরে বরগুনার জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান সস্ত্রীক পরিদর্শন করেছেন এই কৃষক দম্পতির খামার। সেই সঙ্গে সরকারি সহায়তার আশ্বাসও দিয়েছেন তিনি। জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেন, এটা সত্যি একটি চমৎকার উদ্যোগ। অসময়ে তরমুজ চাষ করে তিনি যেভাবে সফল হয়েছেন এটা অনেক কৃষকদের জন্যই অনুকরণীয় হবে। আমরা জেলা প্রশাসন ও কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করব।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর