বৃহস্পতিবার, ৫ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

খুনের তদন্তে ভয়ংকর চক্রের সন্ধান

মির্জা মেহেদী তমাল

খুনের তদন্তে ভয়ংকর চক্রের সন্ধান

রাজধানীর উত্তরার ১৬ নম্বর সেক্টরের কাছে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে জেগে ওঠে কাশফুল। কাশফুলের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতিদিনই দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে যায় নারী পুরুষ। তিন বছর আগে ২০১৮ সালের অক্টোবরেও মানুষের পদচারণায় মুখরিত ছিল কাশবন। কয়েকজন নারী পুরুষ হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা ভিতরে চলে যায়। তাদের মধ্যে একজনের হঠাৎ আর্তচিৎকার। সবাই তখন দৌড়ে তার কাছে গেলে তারা ভয়ে পিছু নিতে থাকে। যে পথে তারা হেঁটে এসেছে, সে দিক দিয়েই দৌড়াচ্ছে। চোখে-মুখে আতঙ্ক। তাদের  ছোটাছুটি দেখে লোকজন ছুটে আসে। জানতে চায় কী ব্যাপার। তারা বলে লাশ। একটি নয়, দুটি। তখন দর্শনার্থীদের মাঝে আতঙ্ক। ছড়িয়ে পড়ে দুই লাশের খবর। সংবাদ পেয়ে আসে পুলিশ।

২০ অক্টোবর উত্তরার ১৬ নম্বর সেক্টরের ২ নম্বর প্লটে কাশবনে ঘেরা স্থান থেকে দুটি অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে তুরাগ থানা পুলিশ। দুটি লাশেরই চেহারা বিকৃত হয়ে যাওয়ায় তাদের শনাক্ত করতে পুলিশ জটিলতার মধ্যে পড়ে। পুলিশও হতবাক। দুটি হত্যাকান্ড কারা ঘটাল। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে লাশ উদ্ধারের খবর প্রকাশিত হয়। পরের দিন ২১ অক্টোবর লাশ দুটি শনাক্ত করেন স্বজনরা। পুলিশ জানতে পারে দুজনেরই গ্রামের বাড়ি ফরিদপুর জেলায়। একজনের নাম কামাল হোসেন ও অন্যজন ইমন শেখ।

ঢাকা মহানগরীর গোয়েন্দা পুলিশ তদন্ত শুরু করে। ঘটনার প্রায় দেড় মাস পর পুলিশ তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে রাজধানীর আদাবরের ঢাকা উদ্যান থেকে গ্রেফতার করে মনির হোসেনকে। একই দিন রাত সাড়ে ১১টার দিকে শনির আখড়া থেকে গ্রেফতার করা হয় মো. ফরিদকে। পুলিশ এদের জেরা করে খুনের রহস্যই শুধু উদঘাটন নয়, সন্ধান পায় একটি ভয়ংকর চক্রের। তারা স্বীকার করে খুনের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত। তুরাগ থানা এলাকার উত্তরার ১৬ নম্বর সেক্টর থেকে কামাল হোসেন ও ইমন শেখের অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল। এরা দুজনই মনির হোসেন ও ফরিদের সঙ্গে একই আন্তজেলা ডাকাত দলের সদস্য ছিলেন। তারা তাদের ডাকাত দলের অন্যান্য সদস্য রেজাউল, আল-আমিনসহ রাজধানীর তুরাগ থানার বেড়িবাঁধ, উত্তরা সেক্টর এলাকা এবং ফরিদপুরসহ আশপাশের বিভিন্ন জেলার কখনো পাকা রাস্তা বা কখনো কাঁচা রাস্তায় চলাচলকারী গাড়ি থামিয়ে ডাকাতি করতেন। এই ডাকাত দলের সদস্যরা দিনের বেলা কখনো রং মিস্ত্রি, কখনো গাড়ির ড্রাইভার-হেলপার হিসেবে কাজ করতেন। গভীর রাতে প্রথমে তারা রোড ডিভাইডারের খন্ড, বড় পাথর ফেলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে রাস্তায় চলাচলকারী প্রাইভেটকার, সিএনজির পথ রোধ করতেন। তারপর ধারালো দা, বঁটি, লোহার রড ও দেশীয় অস্ত্র ব্যবহার করে যাত্রীদের ভয় দেখিয়ে টাকা, মোবাইল, স্বর্ণালঙ্কার লুটে নিতেন। কাজ শেষে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিতেন লুটের মালামাল। আর এই মালামাল ভাগাভাগি থেকেই সৃষ্টি হয় কোন্দল। বিভিন্ন সময় নিহত কামাল ও ইমন লুণ্ঠিত মালামালের অধিকাংশ নিয়ে নেওয়ায় বাকিদের মধ্যে এ নিয়ে অসন্তোষ দেখা দেয়। সর্বশেষ ফরিদপুরে একটি ডাকাতির মালামাল ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছায়। তখনই প্রতিশোধ নিতে গ্রেফতারকৃত আসামি ফরিদ ও মনির হোসেন মিলে কামাল ও ইমনকে হত্যার পরিকল্পনা করেন।

ওই বছরের গত ১৪ অক্টোবর সন্ধ্যায় নিহত কামাল হোসেন ও ইমন শেখসহ আসামি মনির হোসেন, মো. ফরিদ এবং রেজাউল নামের ডাকাত দলের অন্য এক সদস্য ডাকাতির উদ্দেশে তুরাগ থানা এলাকায় উত্তরার ১৬ নম্বর সেক্টরে একত্রিত হন। রাত ৯টার দিকে তারা ডাকাতির উদ্দেশে রওনা দেন। এরপর ১৬ নম্বর সেক্টরের ২ নম্বর প্লটে কাশবনের ভিতর দিয়ে যাওয়ার সময় পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী মনির হোসেন ও ফরিদ তাদের সঙ্গে থাকা ধারালো বঁটি ও লোহার রড দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকেন কামাল হোসেন ও ইমন শেখকে। ওই সময় ভয় পেয়ে সেখান থেকে দৌড়ে পালিয়ে যান অপর ডাকাত সদস্য রেজাউল। প্রায় ১০ থেকে ১৫ মিনিট উপর্যুপরি আঘাত করে রক্তাক্ত ক্ষত-বিক্ষত লাশ ফেলে রেখে সেখান থেকে পালিয়ে যান তারা। আর পালানোর সময় হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত ধারালো বঁটি ও রড রাস্তার পাশে ঝোপের মধ্যে ফেলে দেন তারা। হত্যাকান্ডের পরপরই দুজন গা ঢাকা দেন। গ্রেফতারকৃত আসামি মনির গাবতলী এলাকায় নিজের আবাস ছেড়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ভাসমান অবস্থায় ঘুরে বেড়াতে থাকেন। অন্যদিকে এ হত্যাকান্ডের পর ফরিদ রাজধানী ছেড়ে কুমিল্লার বিভিন্ন এলাকা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় পালিয়ে থেকে ডাকাত দলের সদস্য জড়ো করে পুনরায় ডাকাতির পরিকল্পনা করতে থাকেন। গোয়েন্দা পুলিশ গোপন সূত্র ও তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় তাকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।

সর্বশেষ খবর