শনিবার, ৭ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

বাড়ছে অর্থনৈতিক টানাপোড়েন

মানিক মুনতাসির

বাড়ছে অর্থনৈতিক টানাপোড়েন

টানা প্রায় দুই বছর ধরে চলছে করোনাভাইরাস মহামারী। এর আঘাতে গত বছরের শুরুতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে অর্থনীতি। সামষ্টিক অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই আবারও শুরু হয় করোনাভাইরাসের দ্বিতীয়, তৃতীয় ঢেউ। এতে বিপুলসংখ্যক মানুষ বেকার হয়ে পড়ে। অচল হয়ে যায় জীবনযাত্রা। একইভাবে দৈনন্দিন ব্যয়ের সঙ্গে বেড়ে যায় স্বাস্থ্যপরিচর্যা ব্যয়। এতে করোনায় হু হু করে বাড়তে থাকে জীবনযাত্রার ব্যয়। দিশাহারা হয়ে পড়েছে মানুষ। সরকারি খাতের সঙ্গে বেসরকারি খাতেরও উৎপাদন খরচ ও পরিচালন ব্যয় বাড়ছে। ফলে সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতেই শুরু হয় অর্থনৈতিক টানাপোড়েন, যা শুধুই বাড়ছে। তবে এর মধ্যেও খরা কেটেছে রপ্তানি খাতের। রেমিট্যান্স ও রিজার্ভে সৃষ্টি হয়েছে সর্বোচ্চ রেকর্ড। আবার দুশ্চিন্তা বাড়ছে কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ ও বেকারত্ব নিয়ে।

সূত্রমতে, গত দুই বছরে নতুন করে তেমন কোনো কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়নি। বরং কাজ হারিয়ে বেকার হয়েছে লাখ লাখ মানুষ। এ ছাড়া প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষের আয় কমেছে। নতুন করে দরিদ্র হয়েছে আড়াই কোটি মানুষ। এর বেশির ভাগই দিনের এক ভাগে প্রয়োজনের চেয়ে কম খাচ্ছে। সরকারের হাতেও নেই প্রয়োজনীয় অর্থ। কেননা রাজস্ব আদায়ে তৈরি হয়েছে বিপুল ঘাটতি। ফলে সরকারের ভিতরে ও বাইরে এবং মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে চলছে অর্থনৈতিক টানাপোড়েন। কভিড-১৯-পরবর্তী সময়ে নতুন নতুন অনেক চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

মহামারীর মধ্যেও সমাপ্ত ২০২০-২১ অর্থবছরের রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধিসহ কয়েকটি ইতিবাচক সূচকের দেখা মিলেছে। যদিও সামগ্রিক রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এখনো সাড়ে ৫ শতাংশ পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। ৩০ জুন শেষ হওয়া অর্থবছরে মোট ৩ হাজার ৮৭৫ কোটি ৮৩ লাখ ডলারের (৩৮ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন) পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৫ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি। করোনা মহামারীর মধ্যে রপ্তানির এ প্রবৃদ্ধিকে ইতিবাচকই দেখছেন বিশ্লেষকরা।

সূত্রমতে, গত বছরের মতো সবকিছু বন্ধ না করে শিল্পকারখানা খোলা রেখে এবং গণপরিবহন বন্ধ করে জনমানুষের চলাফেরায় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে সরকার। অবশ্য বর্তমানে শিল্পকারখানাও বন্ধ রয়েছে, যা থাকবে ১০ আগস্ট পর্যন্ত। দেশের বেশির ভাগ মানুষ অপ্রাতিষ্ঠানিক ও বেসরকারি খাতের সঙ্গে জড়িত। ফলে সবকিছু বন্ধ করে দেওয়ায় কার্যত মানুষের জীবনই অচল হয়ে পড়েছে বলে মনে করে সরকার। অথচ সংক্রমণ ও মৃত্যু কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না। বরং প্রতিদিনই বাড়ছে সংক্রমণ হার। এজন্য আবারও শিল্পকারখানসহ অর্থনৈতিক কর্মকান্ড চালু রেখে অন্যান্য ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে যাচ্ছে সরকার। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘গত বছরের একই সময়ের তুলনায় চলতি বছরে দ্বিতীয় দফায় শুরু হওয়া করোনা সংক্রমণকালে দেশের অর্থনীতি কিছুটা হলেও গতিশীল রয়েছে। তবে করোনা মহামারীতে সরকারের দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি ওলটপালট করে দিয়েছে। আগে প্রতি বছর যেখানে ১ শতাংশ হারে দারিদ্র্য বিমোচন হতো সেখানে করোনার কারণে এখন বছরে ৪ শতাংশ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হচ্ছে। যার ফলে করোনাকালে নতুন করে আড়াই কোটি মানুষ চরম দরিদ্রের কাতারে নেমে গেছে।’ আবার অর্থনীতি রিকভারি, করোনা মোকাবিলা ও দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি নতুন করে এক দরিদ্রের ফাঁদে আটকে পড়ছে বলে তিনি মনে করেন।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেন, ‘দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য এখন বিপর্যস্ত। তবে গত বছরের     তুলনায় চলতি বছরের অভিঘাত কিছুটা কম হওয়ায় এ বছর অর্থনীতিটা মোটামুটি গতিশীল ছিল। কিন্তু ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ায় সংক্রমণটা বেড়েছে। ফলে শিল্পোৎপাদন, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সামগ্রিক জীবনযাত্রা আবারও থমকে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যেই ব্যবসা-বাণিজ্য টিকিয়ে রাখতে হচ্ছে।’ তবে সংক্রমণটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে অর্থনৈতিক ক্ষতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে বলে তিনি মনে করেন। এদিকে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে বড় ভূমিকা রাখে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই)। চলমান কঠোর লকডাউনে প্রচন্ড সংকটের মধ্যে পড়েছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা। অবশ্য চলতি বছরের লকডাউনে এ খাতের ব্যবসায়ীদের সংকট গত বছরের তুলনায় কিছুটা কম।

গত বছরের দুটি ও চলতি বছরের দুটি ঈদ গেছে ব্যবসা-বাণিজ্যহীনভাবে। তবে ১১ আগস্ট থেকে আবারও সব ধরনের দোকানপাট, শপিং মল, পরিবহন খুলে দিতে যাচ্ছে সরকার। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য কিছুটা হলেও প্রবৃদ্ধির দিকে এগোবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

সর্বশেষ খবর