সোমবার, ৯ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

তিন বন্ধুর তদন্তে খুনরহস্য

মির্জা মেহেদী তমাল

তিন বন্ধুর তদন্তে খুনরহস্য

সন্ধ্যায় দোকান বন্ধ করে রাজু বাসায় ফিরছিলেন। হঠাৎ রাস্তায় একটি মোবাইল ফোন পড়ে থাকতে দেখেন। তিনি তুলে নেন মোবাইল ফোনটি। চার্জ না থাকায় ফোনটি অফ ছিল। বাসায় গিয়ে রাজু ফোনটি ড্রয়ারে রেখে দেন। ফোনটির কথা আর মনেই ছিল না রাজুর। দেড় মাস পর এক রাতে মশার কয়েল বের করতে ড্রয়ারটি খুলতেই মোবাইল ফোনটি তার চোখে পড়ে। ফোনটি বের করে তিনি চার্জে দেন।

পরদিন সকালে ফোনটি নিয়ে দোকানের দিকে রওনা হন রাজু। পথিমধ্যে একটি কল আসে। কল রিসিভ করার পর এক তরুণ ওই ফোনের মালিকানা দাবি করে ফোনটি ফেরত চান। রাজু তাকে বলেন, আপনার ফোন কুড়িয়ে পেয়েছি। কোনো সমস্যা নেই। প্রমাণ দিয়ে আমার দোকানে এসে নিয়ে যাবেন। তবে প্রমাণ দেখাতে হবে। কিন্তু ওই ব্যক্তি তার নাম পরিচয় জানাতে চান না। তিনি বলেন, পরিচয় আমি দেব না। ফোনটা আমার ফেরত দিন। বিনিময়ে নগদ ৫ হাজার টাকা পাবেন। তবে শর্ত একটা, ফোনটি কোথাও রেখে যেতে হবে। আমি লোক পাঠিয়ে ফোনটি এনে নেব। এভাবে পরিচয় গোপন রাখা এবং টাকার প্রস্তাব দেওয়ায় সন্দেহ দেখা দেয় দোকানদার রাজুর মনে। তিনি ফোনের মেমোরি ঘাঁটাঘাঁটি করতে শুরু করেন। আর তা করতে গিয়ে তিনি সেখানে পেয়ে যান কিছু রেকর্ড করা ফোনালাপ। রেকর্ড শুনেই রাজু স্তম্ভিত।

রেকর্ড শুনে রাজু বুঝতে পারেন, নাসির নামে কোনো এক স্কুলশিক্ষককে হত্যা করেছেন তারই স্ত্রী। আর সেই স্ত্রীর পরিচিত রাজু মিয়া নামের এক ব্যক্তি। হতবাক হন দোকানদার রাজু। নামে মিল  থাকায় একটু ভয়ও পেয়ে যান। কী করবেন, বুঝতে পারছিলেন না। এভাবে কাটে প্রায় এক সপ্তাহ।  রাজু মনে ভাবছিলেন, অযথা উটকো সমস্যা মাথায় নিয়ে লাভ নেই। বরং চেপে যাওয়াই ভালো। কিন্তু পাশাপাশি তিনি এও ভাবতে থাকেন, বিষয়টা চেপে গেলে হয়তো খুনের বিচার হবে না। খুনিরা পার পেয়ে যেতে পারেন। এমন দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যেই রাজুর সঙ্গে দেখা হয় বন্ধু ইয়াকুবের সঙ্গে। কথাচ্ছলে রাজু মোবাইল ফোনের ঘটনাটি তার বন্ধু ইয়াকুবের সঙ্গে শেয়ার করেন। সেইসঙ্গে রেকর্ডগুলোও তিনি শোনান বন্ধুকে। ইয়াকুবও একটু ভয় পান। কিন্তু ভয় পেলে চলবে না, এমন কথাও বলতে থাকেন ইয়াকুব। এমন নির্মম একটি হত্যাকান্ড চাপা পড়ে থাকবে? অপরাধীরা পার পেয়ে যাবে? রাজু আর ইয়াকুব এ নিয়ে নানা ধরনের চিন্তা করতে থাকেন। তারা কি পুলিশকে জানাবে? নাকি চেপে যাবে। পুলিশকে জানালে, আবার কোনো বিপদে পড়তে হয় নাকি, এমন সব কিছু তাদের মাথায় কাজ করছে। একটা সময় তাদের সঙ্গে যোগ দেয় ইয়াকুবের আরেক বন্ধু নাজমুল। তারা তিন বন্ধু নিজেরা আলাপ করে সিদ্ধান্ত নেয়, এ ঘটনার তদন্ত করে খুনিকে শনাক্ত করবে। এরপর তারা পুলিশের কাছে সব ঘটনা ফাঁস করবে। প্রয়োজনে আসামি ধরেই পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হবে। এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে তিন বন্ধু মাঠে নামে। ক্লু লেস খুনের তদন্ত শুরু করে। ঘটনাটি বরগুনা জেলার ঢলুয়া ইউনিয়নের গুলবুনিয়া এলাকার।

প্রথমেই তিন বন্ধু ফোনের মালিক রাজু মিয়াকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে থাকে। অনেক কৌশলের আশ্রয় নিয়ে মোবাইল ফোনের মালিকের কাছে পৌঁছায় তিন বন্ধু।

২০ বছর বয়সী রাজু মিয়া ঢলুয়া ইউনিয়নের গুলবুনিয়া এলাকার বারেক মিয়ার ছেলে। সেই রাজু মিয়াকে রেকর্ডগুলো শোনান এই তিন বন্ধু। রেকর্ডগুলো শোনার পর মুষড়ে পড়েন রাজু মিয়া। তিনি তিন বন্ধুকে বলেন, নাসিরের স্ত্রী মিতুর ষড়যন্ত্রে তিনি এ হত্যার ঘটনা ঘটিয়েছেন। তার এই বক্তব্য কৌশলে তিন বন্ধু ভিডিও রেকর্ড করে রাখেন। যেন পরে অস্বীকার করতে না পারে। এ সময় তিন বন্ধু তাকে আশ্বাস দিয়ে বলেন, তোমার কোনো ক্ষতি হতে দেব না। আমাদের সঙ্গে তুমি থাক।

এরপর তিন বন্ধু খুঁজে বের করেন নিহত নাসিরের বাড়ি। নাসিরের ভাই জলিলের সঙ্গে কথা বলেন তারা। রেকর্ডগুলো তাকে শোনান। কিন্তু আইনের আশ্রয় নিতে কিছুটা অনীহা দেখান জলিল। হতাশ হয়ে পড়েন তিন বন্ধু। কিন্তু থেমে যাননি। তারা এবার নিহতের স্ত্রী মিতুর সন্ধানে বের হন। বরগুনা শহরের থানাপাড়া এলাকায় বাবার বাসায় থাকেন মিতু। স্বামীর মৃত্যুর পর বাসার আসবাবপত্র সরিয়ে বাবার বাড়িতে উঠে গেছেন তিনি। তিন বন্ধু মিতুর বাড়িতে যাওয়ার জন্য কৌশল নেয়। তারা মিতুর বিয়ের প্রস্তাবের জন্য খোঁজ নিচ্ছেন, এমন কৌশল অবলম্বন করে তার ব্যাপারে খোঁজ নিতে থাকেন। পরে মিতুর বাবা বারেক মোক্তারের সঙ্গে দেখা করে রেকর্ডগুলো তাকে শোনান তিন বন্ধু। এসব শোনার পর বারেক মোক্তার বলেন, আমার মেয়ে আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে, আপনারা পুলিশে ধরিয়ে দেন। ওইদিন সন্ধ্যার পর একজন গণমাধ্যমকর্মীর সাহায্যে তিনবন্ধু রেকর্ডগুলো নিয়ে থানায় যান। রাজু মিয়ার স্বীকারোক্তিমূলক ভিডিও, কল রেকর্ড ও সব তথ্য থানা পুলিশের কর্মকর্তার হাতে তুলে দেন তিন বন্ধু। পুলিশ আর দেরি করেনি। ওই রাতেই মিতু ও রাজুকে আটক করে। জিজ্ঞাসাবাদে রাজু ও মিতু উভয়েই পুলিশের কাছে নাসিরকে হত্যার বিষয়টি স্বীকার করেন।

গত বছরের ২৩ মে রাতে বরগুনার নিজ বাড়িতে মারা যান গোলবুনিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ৪৬ বছর বয়সী নাসির। মৃত্যুর কারণ হিসেবে তার স্ত্রী ফাতেমা মিতু জানিয়েছিলেন, স্ট্রোক। সবাই তাই জানত। কিন্তু ঘটনার নয় মাস পর উদঘাটন হয়, অসুস্থতাজনিত কারণে মৃত্যু নয়, তাকে হত্যা করা হয়েছে। মিতু ও রাজু পরস্পর যোগসাজশে এই হত্যাকান্ড ঘটান। ফোনটি ছিল রাজু মিয়ার। হারিয়ে গেছে সেই মোবাইল ফোনের সূত্রেই খুনের রহস্য উদঘাটন হলো। বরগুনা থানার পুলিশ জানায়, স্ত্রী মিতু তার স্বামীকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে রাজু মিয়ার সহায়তায় কম্বলচাপা দিয়ে হত্যা করেন।

কেন স্বামীকে হত্যা করল মিতু? মিতু ও রাজুর কথোপকথনের ১৩টি অডিও ক্লিপেই বোঝা যায়, হত্যার মোটিভ। বোঝা যায়, ইচ্ছেমতো চলাফেরা করতে এবং টিকটক ও লাইকির ভিডিও তৈরিতে বাধা দেওয়ায় স্বামীর ওপর ভীষণ ক্ষুব্ধ ছিলেন মিতু। তাই তাকে মারতে লোক ভাড়া করেছিলেন তিনি।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর