‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আছে বইলগা আমরা খাইয়া পইরা বাঁইচা আছি। সে আমাগো জন্যে চাইল, ডাইল না পাডাইলে এই করোনার মধ্যে আমাগো না খাইয়া মরতে হইতো।’ গতকাল সকালে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার কুশলা ইউনিয়নের পূর্বকান্দি মসজিদ মাঠে তপ্ত রোদে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলছিলেন সত্তরোর্ধ্ব বিধবা মনোয়ারা বেগম। তার চোখেমুখে ফুটে ওঠে উচ্ছ্বাস। ষাটোর্ধ্ব মরিয়ম বেগম, বিধবা ফাতেমা বেগম এবং সত্তরোর্ধ্ব আইয়ুব আলীদের কণ্ঠেও অভিন্ন সুর, ‘আল্লাহ যেন আমাগো শেখ হাসিনাকে অনেক দিন বাঁচাইয়া রাখে।’ বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার ব্যক্তিগত তহবিল থেকে পাঠানো খাদ্যসামগ্রী হাতে পেয়ে এমনই খুশি গোপালগঞ্জের বিভিন্ন এলাকার মানুষ।
জানা গেছে, মহীয়সী নারী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের ৯১তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে কোটালীপাড়ায় চার হাজার প্যাকেট খাদ্যসামগ্রী পাঠান দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। গতকাল সকালে কুশলায় বিতরণের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তিন দিনব্যাপী এ কর্মসূচি। এ ধাপে উপজেলার একটি পৌরসভা এবং ১১টি ইউনিয়নের ১৯৭টি গ্রামের মানুষ পাবে এ সহায়তা।
গতকাল প্রথম দিন খাদ্যসামগ্রী বিতরণের অনুষ্ঠানে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ভবেন্দ্রনাথ বিশ্বাস বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক পরামর্শদাতা ছিলেন বেগম শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব। বেগম শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিটি কাজে পাশে থেকে শক্তি-সাহস জুগিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু যখন জেলে ছিলেন তখন তিনি আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন। নানা ধরনের পরামর্শ দিয়েছেন। আজকের এই দিনে আমরা শ্রদ্ধাভরে এই মহীয়সী নারীকে স্মরণ করছি।’উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আয়নাল হোসেন শেখ বলেন, ‘বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের ৯১তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা তাদের ব্যক্তিগত তহবিল থেকে উপজেলার অসহায় ও দুস্থ মানুষদের মধ্যে বিতরণের জন্য চাল, ডাল, লবণ, আলু, তেলসহ চার হাজার প্যাকেট খাদ্যসামগ্রী পাঠিয়েছেন। কুশলা ইউনিয়নে বিতরণের মধ্য দিয়ে এই বিতরণ কার্যক্রম শুরু হলো। পর্যায়ক্রমে উপজেলার অন্যান্য ইউনিয়ন ও পৌরসভায় এ খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা হবে। এ ছাড়া আমরা আগামী ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়ন ও পৌরসভার প্রতিটি ওয়ার্ডে দোয়া মাহফিল ও দুস্থদের মধ্যে খাদ্য বিতরণের আয়োজন করেছি। এ আয়োজনের জন্য জননেন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের সার্বিক সহযোগিতা করছেন।’
কুশলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুল ইসলাম বাদল বলেন, ‘পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর আমাদের এলাকার উন্নয়ন কর্মকান্ড থমকে যায়। জননেত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর আমাদের এলাকায় রাস্তাঘাট ও সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হতে থাকে। ২০০১ সালে চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর আমাদের এলাকার উন্নয়ন আবার থমকে যায়। সর্বশেষ ২০০৯ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর আমাদের এলাকার উন্নয়নের চাকা ঘুরতে থাকে। দীর্ঘ এই ১২ বছরে উন্নয়ন আবার শুরু হয়। এলাকার দরিদ্র মানুষ খেয়ে-পরে বেঁচে আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় না থাকলে এই জনপদের মানুষদের না খেয়ে মরতে হতো।’
অনুষ্ঠানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফেরদৌস ওয়াহিদ, ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম কিবরিয়া দাড়িয়া, আওয়ামী লীগ নেতা আতিকুজ্জামান খান বাদল, রুহুল আমিন খান, মিজানুর রহমান বুলবুল, উপজেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম তালুকদার, কুশলা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জামাল শেখ, উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম-আহ্বায়ক গাজী খসরু প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
দরিদ্রদের ঘরে ঘরে আনন্দ : অন্যদিকে করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে সারা দেশের মতো গোপালগঞ্জেও প্রধানমন্ত্রীর উপহারের খাদ্যসামগ্রী, নগদ অর্থসহ নানামুখী সহায়তা অব্যাহত রয়েছে। গত অর্থবছর জেলায় ৩ লাখ ২৮ হাজার ৩৯৬ জন উপকারভোগীর জন্য বরাদ্দ ছিল নগদ অর্থ ৯ কোটি ৩১ লাখ ৩১ হাজার ৮৫০ টাকা এবং ১ হাজার ৩৩২ টন খাদ্যশস্য। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসের বরাদ্দ ছিল তুলনামূলক আরও বেশি। ২৮ হাজার ৯৮৪ পরিবারের জন্য দেওয়া হয় ২৯০ টন খাদ্যশস্য এবং নগদ ১০ লাখ টাকা। এ সহায়তার আওতায় আসে ১ লাখ ২৩ হাজার ১৯৭ জন উপকারভোগী।
তবে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের পাশাপাশি দুই বোনের ব্যক্তিগত তহবিল থেকে দেওয়া বিশেষ সহায়তায় কোটালীপাড়া ও টুঙ্গিপাড়ায় হতদরিদ্রদের ঘরে ঘরে বইছে খুশির বান। ত্রাণ নিতে আসা নানা বয়সী মানুষের সঙ্গে আলাপ করে তাদের বিভিন্ন দুর্দশার কথা জানা যায়। পাশাপাশি দুর্দিনে সব সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পাওয়ায় কৃতজ্ঞতাও স্বীকার করেন তারা।
গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার লতিফপুর ইউনিয়নের অনুপ বালা বলেন, ‘করোনার মধ্যে হঠাৎ মোবাইল ফোন বেজে উঠল। ফোনটি ধরতেই অন্য প্রান্ত থেকে বলছেন, “আপনার জন্য প্রধানমন্ত্রী খাদ্য উপহার পাঠিয়েছেন। আমরা আপনার বাড়ির সামনে, দয়া করে উপহারটি নিয়ে যাবেন।” আমি গাড়ির কাছে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডিসি অফিসের স্টাফরা আমার হাতে একটি খাদ্যভর্তি ব্যাগ তুলে দিলেন। ব্যাগটি বাড়ি এনে খুলে দেখি তার মধ্যে চাল, ডাল, তেল, লবণ, সুজি ও সাবান রয়েছে। কোনো দিন ভাবতে পারিনি এভাবে প্রধানমন্ত্রী আমাকে সাহায্য পাঠাবেন।’
টুঙ্গিপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মো. আবুল বাশার খায়ের বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের এমপি। তিনি নিজ উদ্যোগে এবং সরকারিভাবে তার নির্বাচনী এলাকা টুঙ্গিপাড়া ও কোটালীপাড়ায় ত্রাণ বা সাহায্য-সহযোগিতা পাঠান। যেসব সাহায্য-সহযোগিতা দেন সেসব সাহায্য ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মাধ্যমে সমবণ্টন করা হয়ে থাকে।’ তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা সঠিকভাবে বণ্টনের জন্য প্রতিটি ইউনিয়ন বা ওয়ার্ডের মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক, ইমাম, পুরোহিতের সমন্বয়ে তালিকা প্রস্তুত করা হয়ে থাকে। সে অনুযায়ী ত্রাণ বা সাহায্য-সহযোগিতা ভাগ করে দেওয়া হয়। এসব কার্যক্রম সততা ও সর্তকতার সঙ্গে পরিচালনা করা হয়ে থাকে বলেও তিনি জানান।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. আবদুর রহমান বলেন, ‘দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর গোপালগঞ্জে যেসব ত্রাণ বরাদ্দ করে তা উপজেলা, ইউনিয়ন ও পৌরসভাভিত্তিক পরিমাণ নির্ধারণ করে দেয়। সে অনুযায়ী আমরা বণ্টন করে থাকি। এখানে কম-বেশি করার কোনো সুযোগ নেই।’
জেলা প্রশাসক শাহিদা সুলতানা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে জেলায় যেসব সাহায্য-সহযোগিতা আসে সেগুলো সঠিক ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে বণ্টন হয়ে থাকে। এ পর্যন্ত যত ত্রাণ এসেছে তা প্রশাসনের মাধ্যমে সমবণ্টন করা হয়েছে।
টুঙ্গিপাড়া উপজেলার পাটগাতী ইউনিয়নের লেবুতলা গ্রামের কৃষক জাহিদ সর্দার বলেন, ‘করোনাকালে বেশ কয়েকবার ত্রাণ পেয়েছি। সরকারিভাবে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে। আবার প্রধানমন্ত্রী আমাদের জন্য খাবার ও টাকা পাঠিয়ে থাকেন, খোঁজখবর নেন। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীকে অন্তর থেকে ধন্যবাদ জানাই। প্রধানমন্ত্রীর বাবাও গরিব-দুঃখীদের খোঁজখবর নিতেন। মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। তিনিও সেই রকম হয়েছেন।’
বর্নি ইউনিয়নের জুলহাস শেখ বলেন, ‘করোনার সময় প্রধানমন্ত্রী আমাদের খাবার দিয়েছেন, টাকা দিয়েছেন, বাচ্চাদের জন্য শিশুখাদ্য দিয়েছেন। আমরা অনেক ভাগ্যবান। এ রকম প্রধানমন্ত্রী বা এমপি আমরা আর দেখিনি। তার এলাকার ভোটার ও মানুষদের তিনি প্রায়ই সাহায্য-সহযোগিতা করে থাকেন।’
সিঙ্গিপাড়া গ্রামের আবু সাঈদ ফকির বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শুধু আমারে নয়, তার নির্বাচনী এলাকার গরিব-দুঃখী ও কর্মহীন মানুষদের প্রায়ই সাহায্য করে থাকেন। তার গুণের কথা বললে শেষ হবে না। তিনি আমাদের জন্য যে সাহায্য পাঠান তা আমরা সঠিকভাবে পেয়ে থাকি।’
গোপালগঞ্জ শহরের সুজন সাহা বলেন, ‘দোকানে কর্মচারীর কাজ করি। করোনার মধ্যে খুব খারাপ অবস্থা গেছে। মালিক ঠিকমতো বেতন দিত না। তবে দু-তিনবার প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে খাদ্য পেয়েছি। এই খাদ্য না পেলে হয়তো না খেয়ে থাকতে হতো। প্রধানমন্ত্রী যে আমাদের কথা চিন্তা করেন এটাই তার প্রমাণ। এ কারণে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি, শেখ হাসিনা যেন দীর্ঘায়ু লাভ করেন।’