বৃহস্পতিবার, ১২ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

খুনের সাক্ষীকে পাঠানো হলো পাগলাগারদে

মির্জা মেহেদী তমাল

খুনের সাক্ষীকে পাঠানো হলো পাগলাগারদে

রাজধানীর ধানমন্ডি লেক। এক সকালে সিটি করপোরেশনের একজন ঝাড়ুদার ঝাড়ু দিচ্ছিলেন লেকের পাড় ঘেঁষে। বড় একটি বস্তা দেখে তিনি থমকে দাঁড়ান। এক পাশে রক্ত লাগানো। তা দেখে তিনি ঘাবড়ে যান। চারপাশে তাকাচ্ছেন। কাউকে দেখতে পাচ্ছেন না। ধীর পায়ে বস্তার সামনে গিয়ে দেখেন বস্তার মুখ খোলা। বস্তার ভিতরে তাকাতেই তিনি ভয় পেয়ে কিছুটা পিছু হটেন। লাশ বলে চিৎকার করতে থাকেন। প্রাতর্ভ্রমণে আসা লোকজন ঝাড়ুদারের চিৎকারে ছুটে যান। বস্তা ঘিরে ততক্ষণে লোকজনের ভিড়। খবর পেয়ে ছুটে আসে পুলিশ। বস্তার ভিতর একজন নারীর লাশ। লাশটি কয়েক টুকড়া করে কাটা। বয়স আনুমানিক ২০ থেকে ২২ বছর। লাশ পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে। এ ব্যাপারে ধানমন্ডি থানায় একটি মামলা হয়। যেহেতু হতভাগ্য নারীটির নাম-পরিচয় পাওয়া যায়নি, পুলিশ নিজেই মামলার বাদী হয়। ঘটনাটি ২০০৮ সালের।

পুলিশ এই খুনের ঘটনাটি তদন্ত করতে নেমে প্রথমেই তার পরিচয় উদঘাটনের চেষ্টা চালায়। ধানমন্ডির আশপাশের বস্তি বাজার সবখানে খোঁজ নিতে শুরু করে। ধানমন্ডির একটি বাজারের কয়েকটি মুদি দোকানে নারীর ছবি দেখাতে থাকে পুলিশ। একজন মুদি দোকানদার ছবি দেখেই চিনতে পারেন। দোকানদার জানান, এই নারী তার দোকানে বেশ অনেকদিন এসেছেন। অনেক কেনাকাটা করতেন। কিন্তু নাম ঠিকানা জানেন না। তবে সেখানকার একজন কুলি তার ব্যাগ বহন করে রিকশায় তুলে দিতেন। পুলিশ সেই কুলির সন্ধান করে। পেয়েও যান। সেই কুলি পুলিশকে জানায়, রিকশায় তিনি ব্যাগ তুলে দিতেন। ধানমন্ডি ১১ নম্বরে যেতে রিকশা ভাড়া করতেন। এরপর পুলিশ ছুটে ধানমন্ডি ১১ নম্বরে। সেখানকার বেশ কিছু বাড়িতে খোঁজ-খবর নিতে থাকে পুলিশ। ১১ নম্বর রোডের বাসা বাড়ির দারোয়ান ড্রাইভারদের ছবি দেখায়। তাদের একজন ছবি দেখে সেই নারীকে চিনতে পারেন। সেখানকার একটি বাড়িতে সেই নারী কাজ করেন। পুলিশ তদন্তে অনেকটা এগিয়ে যায়। সেই বাড়িতে পুলিশ ঢুকে দারোয়ানের সঙ্গে কথা বলেন। কিন্তু নারীর বিষয়ে কোনো তথ্য পায় না। বাড়িটি ঢনাঢ্য ব্যবসায়ী কবির আহমেদের। তার স্ত্রীর নাম ডলি। পুলিশ তথ্য-প্রমাণ ছাড়া ভিতরে ঢুকতে পারে না। পুলিশ একটা সময় ভিতরে প্রবেশের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু সেখানে গিয়ে পুলিশ জানতে পারে, বাড়ির কেউ নেই। তারা গিয়েছেন গ্রামের বাড়ি রাজশাহীতে।

ইতিমধ্যে পেরিয়ে গেছে প্রায় এক বছর। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনও চলে আসে পুলিশের হাতে। পুলিশ জানতে পারে, সেই নারীটিকে শ্বাসরোধ করে হত্যার পর ধারালো কিছু দিয়ে কয়েক টুকড়া করা হয়। পুলিশের দল যায় রাজশাহীতে। রাজশাহীর ঠিকানা অনুযায়ী পুলিশ পৌঁছে যায় ডলিদের বাড়িতে। পুলিশ কবিরের স্ত্রী ডলির সঙ্গে কথা বলেন। ছবিটি দেখায়। ডলি জানায়, মেয়েটির নাম মর্জিনা। তাদের বাড়িতে কাজ করত। যে বুয়া তাকে দিয়েছিল, তার সঙ্গেই বাড়িতে চলে যায়। আর ফিরে আসেনি। বুয়ার একটি মোবাইল নম্বর ছিল, সেটিও বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। যে কারণে ডলি আর যোগাযোগ করেননি। পুলিশের কাছে এসব তথ্য দিয়ে মোবাইল নম্বরটিও দেয়। পুলিশ চলে আসে ঢাকায়। মেয়েটিকে হত্যা করল কারা, পুলিশ তা নিশ্চিত হতে পারছে না। ডলির কথা বার্তায় পুলিশের কোনো সন্দেহ হয়নি। ডলিরা ঢাকায় আসার পর পুলিশ ছদ্মবেশ নেয়। ছদ্মবেশ নিয়ে একটি মেয়েকে ডলির বাসায় কাজের মেয়ে হিসেবে দিয়ে আসে। কয়েকদিন মেয়েটি সেখানে কাজ করলেও মর্জিনা খুনের বিষয়ে কোনো তথ্য পায় না। তবে ডলির বড় ভাই আমান মাঝে মধ্যেই ঘুমের মধ্যে ভয় পেতেন। তার বোনকে সেটি জানিয়ে বলতেন, তোরা যা করেছিস, আমি ঘুমের মধ্যে ভয় পাই। এ কথাটি পুলিশের দেওয়া কাজের মেয়েটি তদন্তকারীদের জানায়। কিন্তু তথ্য-প্রমাণ তারা পায় না। এভাবেই ধীরে ধীরে মর্জিনা হত্যা মামলাটি আঁধারে হারিয়ে যায়। খুনি শনাক্ত হয় না।

ধানমন্ডি থানায় হঠাৎ এক বৃদ্ধ এসে হাজির। একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে তিনি বলেন তার নাম আমান। ১২ বছর ধরে একটি ঘটনা মনের ভিতর চেপে রেখেছি। কিন্তু আর পারছি না। আমি ঘটনাটি জানাতে চাই। পুলিশ গুরুত্ব দিয়ে তার ঘটনাটি শুনেন। তিনি বলেন, তার বোন ডলির বাসা ধানমন্ডি ১১ নম্বর সড়কে। ১২ বছর আগে তাদের বাসায় একটি কাজের মেয়ে ছিলেন। নাম মর্জিনা। বোনের জামাই কবির ছিলেন লম্পট প্রকৃতির। কাজের মেয়ে রাখা যেত না তার জন্য। এ বিষয়টি তার বোন মুখ বুঝে সহ্য করত। মর্জিনার সঙ্গেও কবিরের অনৈতিক সম্পর্ক ছিল। হাতেনাতে কয়েকবার ধরেছেন ডলি। এ কারণে ডলির চাপে মর্জিনাকে বাসা থেকে বিদায় করতে চায় কবির। কিন্তু মর্জিনা যেতে চায় না। উপরন্তু বিয়ের জন্য চাপ দেয় কবিরকে। এতে কবির ভয় পায়। এক রাতে ডলি আর কবির মিলে মর্জিনাকে হত্যা করে লাশ টুকড়া করে। পরদিন সকালে তিনি ডলির বাসায় গিয়ে এ অবস্থা দেখে ফেলে। এরপর তাকে ভয়ভীতি দেখিয়ে খুনের সঙ্গে জড়িয়ে নেয়। লাশ ফেলে আসে ধানমন্ডি লেকের পাড়ে। এভাবে কেটে যায় বছরের পর বছর। আমান বলতে থাকে, তাদের পৈতৃক সম্পত্তি ডলির জামাই কবির আত্মসাৎ করতে চাইলে আমি বাধা দেই। বলি খুনের ঘটনা বলে  দেব। এর পর জোর করে পাগল বানিয়ে তাকে পাগলাগারদে পাঠিয়ে দেয়। এরপর সেখানে থাকতে হয় চার বছর। সেখান থেকে বেরিয়েই থানায় চলে আসলাম।

পুলিশ ঘটনা শুনে অভিযান চালায় কবিরের বাড়িতে। ডলিকে পাওয়া যায়। কবির লাপাত্তা। ডলিকে দিয়ে ফোন করিয়ে কবিরকে বাসায় ডেকে আনা হয়। পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। ১২ বছর পর খুনের রহস্য উদ্ধার করে পুলিশ।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর