শুক্রবার, ১৩ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

তিস্তা-ধরলা পাড়ে মানুষের কান্না

ভাঙনে বিলীন হচ্ছে একের পর এক বাড়িঘর ফসলি জমি

আলী আজম, কুড়িগ্রাম থেকে ফিরে

তিস্তা-ধরলা পাড়ে মানুষের কান্না

কুড়িগ্রামের তিস্তা ও ধরলা পাড়ের মানুষের কান্না যেন কিছুতেই থামছে না। প্রতিনিয়ত শিকস্তির শিকার মানুষ ভিটেবাড়ি হারিয়ে নিমেষেই অসহায় হয়ে পড়ছে। কৃষিনির্ভর নদীতীরবর্তী মানুষের দুঃখ কেউ বুঝতে চায় না। কোরবানির ঈদের পর জেলার রাজারহাট উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রাম নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। নিঃস্ব হয়েছে হাজারো মানুষ। অসহায় এসব মানুষের দুঃখ-কষ্টের ভাগীদার হতে চায় না কেউ। মাত্র কয়েক দিনে বগুড়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কয়েকটি মসজিদ বিলীন হয়ে গেছে।

নদীভাঙন রোধে সরকারের পক্ষ থেকে ৫৯৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হলেও সেটি বাস্তবায়নে নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। ভুক্তভোগী ও জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, ভাঙন রোধে সময়মতো কাজ শুরু না করা এবং প্রকল্প ঘিরে জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কয়েকজন কর্মকর্তার অনিয়মের কারণেই ভাগ্যের পরিবর্তন হচ্ছে না শিকস্তির শিকার মানুষের।

সোমবার কুড়িগ্রাম সদরের সিএনবি ঘাট, সেনের খামার (নিধিরাম) ও রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়ালডাঙ্গা ইউনিয়নের নদী-সংলগ্ন কয়েকটি গ্রাম ঘুরে ভাঙনে মানুষের অসহায়ত্ব এবং নদীর পাড় রক্ষণাবেক্ষণ প্রকল্পের বিভিন্ন অনিয়মের চিত্র দেখা যায়। কোরবানির ঈদের পরই ভাঙনে বিলীন হয়েছে বেশ কয়েকটি গ্রাম, নিঃস্ব হয়ে পড়েছে            হাজারেরও বেশি বাসিন্দা। নদীভাঙনের ফলে ভেঙে যাওয়া ঘর-বাড়ি অন্যত্র সরিয়ে নিতে দেখা গেছে কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দাদের। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, নদীভাঙনের ফলে তাদের বাড়ি-ঘর তলিয়ে গেলেও কর্মকর্তাদের দেখা মিলছে না। যেভাবে কিংবা যেখানে জিও ব্যাগ ফেলে নদীর ভাঙন থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে, সেখানে বস্তা ফেলছে না পাউবো। যেখানে ড্রেজিং করা হচ্ছে, নিয়মবহির্ভূতভাবে তার পাশেই জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে। ঠিকাদার নিয়োগে পাওয়া গেছে বড় অনিয়মের অভিযোগ। মোটা অঙ্কের অর্থ লুটপাটের জন্য সরকারের নকশা অনুযায়ী বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু করা হয়নি। কাজে অনিয়মের অভিযোগ তুলেছেন স্থানীয় এমপি মো. পনির উদ্দিন আহমেদও। সরেজমিনে দেখা যায়, তিস্তা নদীর পূর্বপাড়ের ভাঙনে গতিয়াসাম, মন্ডলপাড়া, নাখেন্দা, খিতাবখাঁ, বাবুর বাজারসহ কয়েকটি গ্রামের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। এসব গ্রামের কৃষক, জেলে, শ্রমজীবী কয়েক শ পরিবার একাধিকবার শিকস্তির শিকার হওয়ায় মানবেতর-জীবন যাপন করছেন। বিলীন হওয়া বগুড়াপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের সভাপতি আজহার আলী মন্ডল বলেন, কোরবানির ঈদের কয়েক দিন আগে তিস্তার ভাঙনে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায় তার বসতভিটা এবং আরও তিন শতাধিক ঘরবাড়ি। এখন যাদের ঘরবাড়ি অবশিষ্ট আছে, তারা আতঙ্কে রাতে ঘুমাতে পারেন না। শুধু স্কুলটি রক্ষা করতে পাউবো থেকে কিছু জিও ব্যাগ ফেলা হলেও অন্য সময় তাদের খোঁজ থাকে না। এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে বারবার যোগাযোগ করা হলেও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোনো সাড়া মেলে না। কুড়িগ্রাম সদরের সিএনবি ঘাট এলাকায় দেখা যায়, নদীর মাঝখান থেকে ড্রেজিং করা হচ্ছে। পাশেই বালুভর্তি জিও ব্যাগ রাখা হয়েছে। ওই এলাকার বাসিন্দা আবদুর রহমান বলেন, ‘ভাঙনের প্রকোপে ছোটবেলা থেকে নদীর দুই পাড়ে পাঁচবার ঘর বানিয়েছি। যে কূলেই যাই, ভাঙন পিছু ছাড়ে না। এবারও ভাঙনে ঘরবাড়ি হারানোর শঙ্কা দেখা দিয়েছে। বাড়ির পাশে কয়েক শ জিও ব্যাগ জমা রাখা হলেও ভাঙন রোধে আমার ঘরের পাশে কোনো ব্যাগ ফেলা হচ্ছে না। স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, যে জায়গাগুলোতে জিও ব্যাগ ফেললে ভাঙন রোধ করা যাবে সেখানে ফেলা হচ্ছে না। ফলে বিলীন হতে চলেছে সিএনবি ঘাট এলাকা। মোগলবাসা ইউনিয়নের সেনেরখামার এলাকায় ধরলা নদীর বাঁধ ভেঙে গ্রামের ভিতর ঢুকে গেছে। এতে বর্ষা মৌসুমে বন্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে বেশ কয়েকটি গ্রামকে। বাঁধ নির্মাণে প্রকল্প পাস হলেও সেটি শুরু হচ্ছে না খরচ বাঁচানোর জটিলতায়। সেনেরখামার এলাকার বাসিন্দা মরিয়ম বলেন, নদী যেহেতু ভেঙে গ্রামের মাঝ দিয়ে ঢুকেছে, তাই সোজাসুজি বাঁধ নির্মাণ করলে পুরো গ্রাম রক্ষা হবে। কিন্তু খরচ কমাতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা চাইছেন তীর দিয়ে মাটি ফেলতে। বাঁধ নির্মাণ নিয়ে জেলা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলীসহ কয়েকজনকে দায়ী করছেন কুড়িগ্রাম-২ আসনের এমপি মো. পনির উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘৫৯৫ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদনের পর জেলা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী দরপত্র আহ্বান করেন। ঘুষ নিয়ে নির্বাহী প্রকৌশলীর পছন্দের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ায় তিস্তা-ধরলা নদীর তীররক্ষা প্রকল্পের অগ্রগতি নেই। নদীর ভাঙনে ঝুঁকিতে থাকা কয়েকটি উপজেলায় ত্বরিত গতিতে কাজ করতে কর্মকর্তাদের বলেছি। কিন্তু তারা “দেখছি, দেখব” বলে কিছুই করছেন না। এমনকি তাদের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকেও পাওয়া যাচ্ছে না। উল্টো তারা আমাকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করছেন।’ এমপির অভিযোগ, নির্বাহী প্রকৌশলীসহ অন্যরা কারও ইঙ্গিতে কিংবা যোগসাজশে এমন অনিয়ম করছেন।

তিনি বিষয়টি পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী, মন্ত্রণালয়ের সচিব ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে লিখিত আকারে জানিয়েছেন। এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কুড়িগ্রাম জেলা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুল ইসলামকে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তা বন্ধ পাওয়া গেছে। এসএমএস পাঠানো হলেও তিনি কোনো জবাব দেননি।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর