শনিবার, ১৪ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

আছেন বিদেশে খুন দেশে

মির্জা মেহেদী তমাল

আছেন বিদেশে খুন দেশে

মুন্সীগঞ্জের উত্তরকান্দি গ্রাম। সাতসকালে ধান খেতে মস্তকবিহীন একটি লাশ চোখে পড়ে গ্রামবাসীর। মাথা না থাকলেও লাশের শরীর দেখেই তারা চিনতে পারেন। লাশটি একজন প্রতিবন্ধীর। কয়েক বছর ধরেই গ্রামে ঘোরাফেরা করছিল। ভবঘুরে এ ব্যক্তির কোনো ঘর নেই। কোথা থেকে এ প্রতিবন্ধী যুবকটি এসেছে তা কেউ জানে না। বিভিন্ন বাসাবাড়ি থেকে তাকে তিন বেলা খাবার দেওয়া হতো। এভাবেই দিন কাটছিল। কিন্তু নিরীহ এ প্রতিবন্ধীকে কেন এবং কারা হত্যা করল গ্রামবাসী চিন্তাও করতে পারছেন না। ছুটে আসে পুলিশ। লাশ উদ্ধারের সময় পুলিশ তার প্যান্টের পকেট থেকে দুটি মামলার কাগজপত্র খুঁজে পায়। নাটোর জেলা আদালতে করা মামলার কপি। বিদেশে লোক পাঠানোর কথা বলে টাকা নিয়ে আত্মসাতের মামলা। যে ব্যক্তি কথা বলতে পারে না, শারীরিকভাবে অক্ষম এমন একজন প্রতিবন্ধীকে নৃশংসভাবে হত্যা এবং তার পকেটে নাটোর আদালতের মামলার কপি দেখে পুলিশ অবাক। ভাবনায় পড়ে পুলিশ। মুন্সীগঞ্জ থানায় মামলা হয়। ২০১৭ সালের অক্টোবরের ঘটনা এটি।

পুলিশ ধারণা করে, যেহেতু এ প্রতিবন্ধীর প্রকৃত পরিচয় কেউ জানে না, এমনও হতে পারে তার বাড়ি নাটোর। মামলা-মোকাদ্দমা নিয়ে যাদের সঙ্গে সমস্যা হয়েছে তারাও হয়তো তাকে খুন করতে পারে। নাটোরে খোঁজ নিলেই খুনের রহস্য বের করা সম্ভব হবে। এমন চিন্তাভাবনা করে পুলিশ নাটোরের সিংড়া থানায় যোগাযোগ করে। ইতিমধ্যে তদন্ত কর্মকর্তা দুবার পরিবর্তন হয়। পরে তদন্তের দায়িত্ব হস্তান্তর হয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআইর ওপর। নতুন ভাবে তদন্ত শুরু করে পিবিআই। পিবিআইর তদন্ত কর্মকর্তা প্রতিবন্ধী যুবকের প্যান্টের পকেটে পাওয়া মামলার কপি দেখে সন্দেহ করেন। প্রতিবন্ধীর পকেটে কেন থাকবে মামলার কপি! আর এ মামলায় মুন্সীগঞ্জের শিলই উত্তরকান্দির ডালিম শেখসহ ছয়জনকে আসামি করা হয়েছে। পুলিশ ডালিম শেখদেরও সন্দেহের তালিকায় রাখে। ডালিমকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। কিন্তু ডালিম জানান, তাদের বংশের কেউ আদম ব্যবসা করেন না। আর যিনি মামলার বাদী নাটোরের সেই বাচ্চুকেও চেনেন না। শুধু তাই নয়, ডালিম শেখ কখনো নাটোর যাননি। তাহলে খুন করল কে! বিপাকে পড়ে পুলিশ।

পিবিআইর তদন্ত দল এবার যায় নাটোর। বাদীর খোঁজ করে। কিন্তু বাদীর নাম-ঠিকানা সব ভুয়া প্রমাণ পায়। ঠিকানামতে বাচ্চু নামে কাউকে খুঁজে পায় না। আদালতে দায়ের করা সে মামলার আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করে পুলিশ। আইনজীবী পুলিশকে জানান, বাদী মামলা করার সময় এসছিলেন। এরপর আর আসেননি। আইনজীবীকে তার টাকাও দেননি। তার নাম-ঠিকানাও বলতে পারেন না। বাদীর অনুপস্থিতির কারণে আদালত মামলাটি পরে খারিজ করে দেয়। আইনজীবীর কাছ থেকে এমন সব তথ্য পেয়ে হতাশ পুলিশ।

পুলিশ ফিরে যায় মুন্সীগঞ্জে। নাটোরের মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে তার অন্যতম ডালিম শেখের কাছে যায় পুলিশ। ডালিমের কাছে জানতে চায় তাদের সঙ্গে কারও শত্রুতা আছে কি না। ডালিম জানান আছে, একই এলাকার শফিক গাজীর সঙ্গে তাদের পুরনো দ্বন্দ্ব জমি নিয়ে। তাদের ভিটাজমি দখল করতে শফিক গাজী অনেক দিন ধরে চেষ্টা করছেন। পুলিশ শফিক গাজীকে থানায় নিয়ে আসে। জানতে চায় ঘটনার সময় তিনি কোথায় ছিলেন? শফিক গাজী জানান তিনি তখন ভারতে ছিলেন চিকিৎসার জন্য। এ বিষয়ে পাসপোর্ট ভিসায় বাংলাদেশ থেকে ভারত যাওয়া আর বাংলাদেশে ফেরার সিল রয়েছে। কাগজপত্র বলে, ঘটনার সময় শফিক গাজী রয়েছেন ভারতে। পুলিশ আবারও ভাবনায় পড়ে। শফিক গাজী খুনের সঙ্গে নন, তবে খুন করল কে? এমন সব প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে পুলিশের মাথায়।

পুলিশ এবার ভিন্ন পথে এগোয়। শফিক গাজীসহ আরও বেশ কয়েকজনের ফোনের কল রেকর্ড পরীক্ষা করে। কল রেকর্ড দেখে আঁতকে ওঠে। দেখা যায় মামলাটি যেদিন রেকর্ড হয়েছিল সেদিন শফিক গাজীর অবস্থান ছিল নাটোর আদালত প্রাঙ্গণে। কাগজে তিনি ভারতে থাকলেও সশরীরে ছিলেন নাটোরে। পুলিশ অনেকটাই নিশ্চিত খুনি তাদের শনাক্ত হয়েছে।

পুলিশ আবারও ডেকে আনে শফিক গাজীকে। সঙ্গে তার সহযোগী মান্নানকেও। জেরা করতে গিয়ে পুলিশ শফিক গাজীর কাছে একটি ফোন নম্বর পায়। শফিক গাজী জানান, ফোনটি রাজশাহীর এক বন্ধুর। পুলিশ ওই ফোন নম্বরের রেজিস্ট্রেশন খুঁজে দেখতে পায় সেটি হিলির। বিগত পাঁচ মাস ধরে সেটি জয়পুরহাট অঞ্চলেই আছে। ঠিকানা অনুযায়ী পুলিশ খোঁজ নিয়ে জানতে পারে ফোনের মালিক আমজাদ একজন কসাই। প্রতিবন্ধী যুবকটিকেও জবাই করে হত্যা করায় পুলিশ নিশ্চিত হয় আমজাদকে দিয়েই হয়তো খুন করানো হয়েছে। পুলিশ তাকে গ্রেফতারের পর জেরা করে। আমজাদ জানান, তিনি হিলিতে লাইনম্যানের কাজ করেন। কসাইয়ের কাজ করেন সপ্তাহে এক দিন। খুন সম্পর্কে কিছু না জানলেও মুন্সীগঞ্জের শফিক গাজীকে তিনি চেনেন। হিলির ব্যবসায়ী হকের অনুরোধে শফিক গাজীকে ভারত থেকে চোরা পথে হিলি দিয়ে বাংলাদেশে এনেছিলেন। আবার বাংলাদেশ থেকে হিলি দিয়ে ভারতে ঢুকিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। পুলিশ আমজাদকে মুন্সীগঞ্জ নিয়ে যায়।

এদিকে শফিক গাজীকে পুলিশ জেরা করতে গিয়ে আমজাদের কথা বলে। কিন্তু তিনি চেনেন না বলে জানান। আমজাদকে তার মুখোমুখি করা হয়। আমজাদকে দেখেও না চেনেন না। কিন্তু আমজাদ তথ্য-প্রমাণ দেখালে আর অস্বীকার করতে পারেন না শফিক গাজী। খুনের ঘটনা স্বীকার করে নেন।

পুলিশ জানতে পারে ডালিম শেখদের ফাঁসানোর জন্য তিনি এ পরিকল্পনা করেন। হত্যার আগে ভারত যান। ভারত থেকে চোরা পথে দেশে ফিরে নাটোরে একটি মামলা করেন ডালিমদের বিরুদ্ধে। প্রতিবন্ধী যুবককে খুন করে লাশ ফেলে রাখেন ডালিমদের বাসার আশপাশে। আর মামলার কপি লাশের প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে দেন। যেন পুলিশ লাশ উদ্ধারের পর ডালিমদের গ্রেফতার করে। মামলাটি এমনভাবে করেছেন যেন পুলিশ ভাবে বিদেশে পাঠানোর টাকা আত্মসাৎ করতেই যুবকটিকে হত্যা করেছেন ডালিমরা। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। পুলিশ জানায়, খুনি যতই ধূর্ত হোক সে কিছু একটা প্রমাণ রেখেই যায়। তার সূত্র ধরে গ্রেফতার হয় খুনি। যেভাবে গ্রেফতার হলেন খুনি শফিক গাজী।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর