বুধবার, ১৮ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

মা খুনের বাদী খুনি একজনই

মির্জা মেহেদী তমাল

মা খুনের বাদী খুনি একজনই

নূরজাহান বেগমের দুই ছেলে, বেলাল এবং হুমায়ুন। বেলাল তার প্রথম ঘরের সন্তান। দুই ছেলেই বিবাহিত। দুই ছেলে আর ছেলের বউদের নিয়ে পাঁচজনের পরিবার। তাদের দিন ভালোই কাটছিল। কিন্তু তাদের পরিবারে হঠাৎ একটি ঘটনায় সবকিছু ওলটপালট হয়ে যায়।

বড় ছেলে বেলাল তাদের মা এবং ছোট ভাই হুমায়ুনকে জামিনদার করে স্থানীয় সুদ ব্যবসায়ী হামিদ এবং ইসমাইলের কাছ থেকে ব্যবসার জন্য ৪ লাখ টাকা নেন। কিন্তু ব্যবসায় লোকসান করেন বেলাল। একদম পথে বসে যান। সুদ ব্যবসায়ীরা টাকা ফেরত পেতে বেলালকে চাপ দিতে থাকে। জমিজমা লিখে দিতে বলে। এমন অবস্থায় লোন রেখেই হার্ট অ্যাটাক করে মারা যান বেলাল। বেলালের এই মৃত্যুর পরই নূরজাহানের পরিবারে নেমে আসে ঝড়। নোয়াখালী জেলার সুবর্ণচরের চর জব্বার থানা এলাকার ঘটনা এটি।

এক ভোরে ঘুম থেকে উঠেই হুমায়ুন দেখতে পান তার মায়ের রুমের দরজা খোলা। ভিতরে তার মা নেই। ঘুম থেকে তার স্ত্রীকে জাগিয়ে তুলে মায়ের কথা জিজ্ঞেস করেন। পুরো বাড়ির প্রতিটি কক্ষ, আশপাশে খেঁাঁজ নিয়ে মায়ের সন্ধান পায় না। হুমায়ুনের স্ত্রী বলেন, হয়তো শামুক তুলতে নদীর কাছে যেতে পারেন। না হয়, টাকার জন্য কোথাও যেতে পারেন। কারণ নূরজাহান বেগমও বেশ কিছু মানুষের কাছে টাকা পান। এর মধ্যে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়েছে নূরজাহানেরই            আপন ছোট ভাই। টাকা নিয়ে ভাই বোনের মধ্যে মনোমালিন্য চলছিল বেশ কিছু দিন ধরে। হুমায়ুন আর তার স্ত্রী এমন সব বিষয় নিয়ে কথা বলে সকালের নাস্তা খেতে বসে। সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়, তাদের মায়ের কোনো খবর নেই। বিকালে গ্রামের মানুষের মুখে মুখে ধানখেতে এক মহিলার লাশ উদ্ধারের খবর। শুধু তাই নয়, লাশটি ধারালো অস্ত্র দিয়ে পাঁচ খন্ড করা। স্থানীয় সুদ ব্যবসায়ী হামিদ এবং ইসমাইলের ধানখেতে লাশের পাঁচ টুকড়া ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ধানখেতের আইলে শামুক তুলতে গিয়ে এক মহিলার নজরে পড়ে একটি খন্ডিত হাত। এরপর তার কাছ থেকেইে ছড়িয়ে পড়ে লাশ পড়ে থাকার ঘটনা। এ খবর চলে যায় পুলিশের কাছে। চর জব্বার থানা পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে। লাশের টুকড়াগুলো দেখে পুলিশ হতবাক। এভাবে নৃশংসভাবে কেউ হত্যা করতে পারে এক বৃদ্ধাকে! পুলিশ সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করতে থাকে।

বিকালে ঘরে শুইয়ে ছিল হুমায়ুন। তার কাছেও লাশ উদ্ধারের খবরটি পৌঁছে। অজ্ঞাত কোনো মহিলার লাশ উদ্ধারের এমন খবরে হুমায়ুনের বুকে ধাক্কা লাগে। অজানা আশঙ্কা নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। এক রকম দৌড়াতে দৌড়াতে পৌঁছে যান সেই ধানখেতের কাছে। সেখানে ততক্ষণে হাজারো মানুষের ভিড়। পুুলিশ লাশের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সুরতহাল তৈরি করছিলেন। হুমায়ুন লাশের টুকড়াগুলোর সামনে গিয়ে ভালো করে দেখতে থাকে। চিনতে পারছিলেন না। হঠাৎ তার চোখে পড়ে সেখানে বেশ কিছু শামুক পড়ে আছে। শামুক রাখার একটি থলেও দেখতে পান। সেই থলে তার পরিচিত। তার মায়ের কাছে থাকে। তখনই চিৎকার করতে থাকে হুমায়ুন। খন্ডিত মাথা দেখে নিশ্চিত হয় লাশটি তার মায়ের। গগনবিদারি আহাজারিতে সেখানকার বাতাস ভারী হয়ে আসে। গ্রামবাসীরা তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে। পুলিশ লাশ পাঠায় ময়নাতদন্তের জন্য।

থানায় যায় হুমায়ুন। সঙ্গে ছিল মা নূরহাজাহানের ছোট ভাই। হুমায়ুন তার মায়ের হত্যাকান্ডের জন্য বাদী হয়ে হত্যা মামলা দায়ের করেন। এ সময় পুলিশকে বলেন, যে কোনোভাবেই হোক হত্যাকারীদের গ্রেফতার করতে হবে। তিনি তার মায়ের হত্যার বিচার চেয়ে পুলিশের সামনে কান্না করতে থাকেন। একইভাবে হাউমাউ করে কান্না করতে থাকেন হুমায়ুনের মামা। পুলিশ তদন্ত শুরু করে। যে ধানখেতে লাশটি পাওয়া গেছে, সেটির মালিক সুদ ব্যবসায়ী হামিদ এবং ইসমাইল। পুলিশ তদন্তের শুরুতেই চিন্তা করেছে সুদ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যেহেতু তাদের ঝামেলা ছিল তারাও খুন করতে পারে। কিন্তু খুন করলেও কেনই বা নিজেদের জমিতে লাশ ফেলে রাখবে। পুলিশের ধারণা, খুনটি অন্য কেউ করেছে। জড়িত থাকতে পারে একাধিক লোক। তবে এমন কোনো লোক লাশটি টুকড়া করেছে, যিনি এ কাজে পারদর্শী।

পুলিশ প্রথমেই হুমায়ুনের স্ত্রীর কাছে গিয়ে খুনের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। পুলিশ তার কথা বোঝার জন্য প্রথমেই প্রশ্ন রাখে, আপনি আপনার শাশুড়িকে কেন খুন করলেন? খুন করে আবার টুকড়া টুকড়াও করলেন। এটি কি আপনি করেছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে থতমত খেয়ে যায় হুমায়ুনের স্ত্রী। তিনি জবাবে বলেন, আমি কি কসাই নাকি যে লাশ টুকড়া করব। কসাই শব্দটি শুনেই পুলিশের মাথায় নতুন একটি সূত্র খুঁজে পায়। এরপর পুলিশ হুমায়ুনকে তাদের পরিচিত একজন কসাইর নাম জানতে চায়। হুমায়ুনের মুখ থেকে প্রথমেই নুরুল ইসলাম ওরফে আতা কসাইয়ের নাম বেরিয়ে আসে। পুলিশ তখনই চলে যায় আতা কসাইয়ের কাছে। আতা কসাইকে পাকড়াও করে পুলিশ। জেরা করতে থাকে। আতা কসাই জানায়, সে খুনের বিষয়ে কিছু জানে না। তবে গ্রামের নীরব নামে এক যুবক তার কাছ থেকে খাসি কাটতে একটি বড় চাপাতি নিয়ে গেছে। পুলিশ এ তথ্য পেয়েই অভিযান চালায় নীরব গ্রেফতারে। সুবর্ণচরের চরজব্বার ইউনিয়নের জাহাজমারা এলাকা থেকে গ্রেফতার হয় নীরব। নীরব পুলিশকে জানায়, চাপাতি দরকার ছিল হুমায়ুনের। হুমায়ুনের কারণেই সে আতা কসাইয়ের কাছ থেকে চাপাতি এনে দেয়। পুলিশ এবার অনেকটাই নিশ্চিত, খুনি কে? পুলিশ সোজা অভিযান চালায় নূরজাহানের বাড়িতে। নূরজাহান খুনের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে তারই সন্তান হুমায়ুন এবং তার স্ত্রীকে পুলিশ গ্রেফতার করে। থানায় নিয়ে চলে জেরা। হুমায়ুন বুঝতে পারে, তার সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই। স্বীকার তাকে করতেই হবে। এক পর্যায়ে স্বীকার করে হুমায়ুন। তার বৃদ্ধা মাকে কেন কীভাবে হত্যা করা হয়েছে- পুলিশের কাছে সব ফাঁস করে ধীরে ধীরে। নিহত নূরজাহানের প্রথম সংসারের ছেলে বেলাল হোসেন বছরখানেক আগে মারা গেছেন। তার রেখে যাওয়া বিভিন্ন  বেসরকারি সংস্থা ও ব্যক্তির ঋণের প্রায় ৪ লাখ টাকা পরিশোধ নিয়ে দ্বিতীয় সংসারের ছেলে হুমায়ুন কবিরের সঙ্গে কিছুদিন ধরে মায়ের বনিবনা হচ্ছিল না। এ ছাড়া নূরজাহান তার ভাইয়ের কাছে মোটা অঙ্কের টাকা পেতেন। লোন শোধ করতে ভাইয়ের কাছে সেই টাকা ফেরত চান। এ নিয়েও ভাই বোনের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হয়। হুমায়ুন কবিরের কাছে তার মামা এসে হত্যার প্রস্তাব দেয়। মায়ের ওপর ক্ষুব্ধ হুমায়ুন রাজি হয়ে যায়। তার মামা তাকে বোঝাতে সক্ষম হয় যে, নূরজাহানকে হত্যা করতে পারলে সব সম্পদের মালিক সে একাই হবে। লোন শোধ করে রাজার হালে সে জীবন যাপন করতে পারবে। রাজি হয়ে যায় হুমায়ুন।

পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২১ সালের ৬ অক্টোবর রাত সাড়ে ৯টা থেকে ১২টার মধ্যে ওই নারীকে প্রথমে বালিশচাপা দিয়ে হত্যা করা হয়। পরে লাশ পাঁচ টুকরা করে প্রতিবেশী পাওনাদারদের ধানখেতে রেখে আসা হয়। হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত মাংস কাটার ধারালো অস্ত্র, বঁটি, একটি কোদাল ও নারীর পরনে থাকা শাড়ি উদ্ধার করা হয়েছে। দুই সপ্তাহ পর পুলিশ ঘটনার রহস্য উদঘাটন করতে সমর্থ হয়। ওই হত্যাকান্ডের ঘটনায় করা প্রথম মামলার বাদী নিহত নূরজাহানের ছেলে হুমায়ুন কবিরকে দ্বিতীয় মামলার প্রধান আসামি করা হয়েছে। তার সহযোগী হিসেবে আরও ছয়জনকে আসামি করা হয়েছে। আসামিদের মধ্যে কসাইসহ দুজন ভাড়াটে, দুজন প্রতিবেশী ও দুজন স্বজন আছেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর