সোমবার, ২৩ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

এক টার্গেটে দুই খুন

মির্জা মেহেদী তমাল

এক টার্গেটে দুই খুন

রাসেলের বাড়ি খুলনার রূপসায়। কৃষিকাজ করেন। সকালে খেতে যান, সন্ধ্যায় ফেরেন। মাকে নিয়ে তার ভালোই চলছিল সংসার। তাদের পাশের বাড়ির মেয়েটির বিয়ে হয় ঢাকার যাত্রাবাড়ীর সজলের সঙ্গে। সজল তাদের এলাকার জামাই। সজল যখন শ্বশুরবাড়িতে আসেন, রাসেলের সঙ্গে সময় কাটান। খেত থেকে সন্ধ্যায় ফিরে আসার পর অনেক রাত পর্যন্ত সজলের সঙ্গে আড্ডা দেন রাসেল। সজলের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়। দিনে দিনে তাদের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। এ ছাড়া সজলের বিরুদ্ধে ঢাকায় মামলাও রয়েছে বেশ কয়েকটি। পুলিশ তাকে ধরতে আসবে জেনে আগে থেকে ঢাকা ছাড়েন সজল। অনেক সময় সজল শ্বশুরবাড়িতে গেলেও রাতযাপন করতেন রাসেলের বাসায়। তুই এভাবে কৃষিকাজ করিস কেন? ঢাকায় চল। তোকে আমি ভালো কোনো জায়গায় চাকরির ব্যবস্থা করে দেব। এক দিন সন্ধ্যায় আড্ডা দিতে গিয়ে সজল এমন প্রস্তাব দেয় রাসেলকে। রাসেল বলে, মা ছাড়া তার আর কেউ নেই। ঢাকায় গেলে মাকে দেখার কেউ থাকবে না। তখন সজল তাকে বোঝায়, কিছুদিন ঢাকায় চাকরি করার পর অনেক টাকা হবে। তখন মাকে ঢাকায় নিয়ে যাবি। সুখে-শান্তিতে দিন কাটাবি। এমন নানা স্বপ্ন দেখায় সজল। এক সময় রাসেল রাজি না হয়ে পারে না। অল্প কিছুদিনের কষ্ট যদি সারা জীবনের শান্তি নিয়ে আসে, তবে তো ছোট কষ্ট মেনে নেওয়াই যায়। এমন নানা কথা চিন্তা করে ঢাকায় যেতে রাজি হয় রাসেল। কিন্তু আজ নিচ্ছি, কাল নিচ্ছি এমন করতে করতেই অনেক সময় পার করে ফেলে সজল। এতে করে মন খারাপ করে রাসেল। কারণ ইতিমধ্যে বেশ কিছু টাকাও সজলের পেছনে খরচা হয়ে গেছে। লোনও নিয়েছে সজল কিছু টাকা।

এক দিন রাসেল তার মায়ের কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা নিয়ে সজলের সঙ্গে বাসা ছাড়ে। সজল তাকে আপাতত একটি টায়ার তৈরির কারখানায় চাকরির ব্যবস্থা করে দেবে। এমন আশ্বাসে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয় রাসেল। সেদিন ছিল ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫ সাল। রাসেল যাত্রাবাড়ীর কদমতলীতে ওঠে। সেখানেই থাকে তার বন্ধু সজল। কিন্তু ঢাকায় এসে চাকরির ব্যাপারে কোনো কথা বলে না সজল। তাদের মধ্যে শুরু হয় মনোমালিন্য। প্রথমদিনই তাদের দুজনের মধ্যে তর্কবিতর্ক হয়। সজল তার চাকরির ব্যবস্থা দ্রুত করবে বলে আশ্বস্থ করে।

রাসেলের দিন কাটে ঘরে বসে। মাঝে মধ্যে সজল তার বিভিন্ন অপরাধকান্ডে নিয়ে যায় রাসেলকে। কিন্তু রাসেল সব সময় যেতে চায় না। সে ফিরে যেতে চায় গ্রামে। সজল আবারও তাকে আশ্বস্থ করে। রাসেল তার মায়ের সঙ্গে রাতে কথা বলে। মা কাঁদে। ফিরে যেতে বলে রাসেলকে। কিন্তু গ্রামে ফিরতে পারে না সজলের জন্য।

একই বছরের ১৩ অক্টোবর রাসেলের মায়ের কাছে ফোন যায়। অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি তাকে জানায়, রাসেলকে হত্যা করা হয়েছে। তার লাশ আছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে। এমন কথা শুনে মা খুলনা থেকে ঢাকায় ছুটে আসেন। মর্গে গিয়ে তার সন্তানের লাশ শনাক্ত করেন। দুই দিন আগেই কে বা কারা তাকে হত্যা করে ফেলে যায় কদমতলীতে। ওই ঘটনায় মা রাশিলা বেগম (৪০) অজ্ঞাতদের বিরুদ্ধে কদমতলী থানায় একটি মামলা দায়ের করেন, মামলা নম্বর-১৯।

কদমতলী থানা পুলিশ তদন্ত শুরু করে। কিন্তু দীর্ঘ দুই বছর তদন্ত করেও খুনিদের শনাক্ত করতে পারেনি। ঘটনাটি পেনাল কোডের ৩০২/৩৪ ধারার অপরাধ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হলেও কে বা কারা জড়িত তা উদঘাটন করা সম্ভব হয়নি উল্লেখ করে ২০১৭ সালের ১৬  সেপ্টেম্বর চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করে কদমতলী থানা পুলিশ। তবে খুনের রহস্য উদঘাটিত না হওয়ায় চূড়ান্ত রিপোর্টের বিরুদ্ধে রাসেলের মা আদালতে নারাজির আবেদন করেন। পরে আদালতের আদেশে পিবিআই, ঢাকা মেট্রোর (উত্তর) এসআই আল-আমিন শেখ মামলাটির তদন্ত শুরু করেন। মামলার তদন্তভার গ্রহণ করে ক্লু-লেস রাসেল হত্যাকান্ডের রহস্য উদঘাটনে ব্যাপক তদন্ত শুরু করে এসআই আল আমিন। ২০১৮ সালের গত ৯ ফেব্রুয়ারি বাগেরহাট জেলার মোরেলগঞ্জ থানার আমতলী এলাকা থেকে সজল ওরফে পিচ্চি সজলকে আটক করে, পরে তার দেওয়া তথ্যে ওইদিন রাতে রাসেল হত্যায় জড়িত আরেক আসামি হোসেন বাবু ওরফে হুন্ডা বাবুকে শ্যামপুর থানাধীন হাজীগেট ব্যাংক কলোনি হতে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশ জানতে পারে রাসেল খুনের পেছনের কথা।

সজলের পরিচিত পিংকি ও পারভেজ কদমতলী-শ্যামপুর থানা এলাকার মাদক ও অস্ত্র ব্যবসায়ী। পিংকি ও পারভেজের মধ্যে এলাকার মাদক ব্যবসার প্রভাব বিস্তার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছিল। বিরোধের জের ধরে মাদকসম্রাজ্ঞী পিংকি পারভেজকে খুন করার জন্য বাবু ওরফে হুন্ডা বাবু ও সজলদের ভাড়া করে। পারভেজকে খুন করার উদ্দেশে সু-কৌশলে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে ২০১৫ সালের ১০ অক্টোবর রাতে সজল, হুন্ডা বাবু, জুয়েল, আল-আমিন একত্রিত হয় কদমতলী থানাধীন বরইতলা মোড়ে। মনোমালিন্যের শোধ নিতে সেখানে সজল কৌশলে রাসেলকেও নিয়ে আসে। পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী ইয়াবা সেবন শেষে চাকু দিয়ে এলোপাতাড়িভাবে পারভেজ ও রাসেলকে আঘাত করে সজল, হুন্ডা বাবু, জুয়েল, আল-আমিন পালিয়ে যায়। পরে গুরুতর অবস্থায় পারভেজ ও রাসেল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে রাসেল মারা যান।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর