বুধবার, ২৫ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

সুখের বদলে বন্দীজীবন

মির্জা মেহেদী তমাল

সুখের বদলে বন্দীজীবন

নাটোরের রফিকুল ইসলাম বিয়ে করেন একই এলাকার উম্মে ছালমাকে। পারিবারিকভাবেই তাদের বিয়ে হয়। পেশাগত কারণে রফিকুল ইসলাম স্ত্রীকে নিয়ে নাটোর থেকে চট্টগ্রামে চলে যান। সীতাকুন্ডের ভাটিয়ারী এলাকায় একটি বাসা ভাড়া করেন। সেখানেই তাদের বসবাস। রফিকুল ইসলামের সঙ্গে তার স্ত্রীর সম্পর্ক খুব ভালো। সময় সুযোগ পেলেই তারা দুজনে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়তেন। কখনো বাসার সামনের খোলা মাঠে দুজনে হাঁটতেন। কখনো রিকশায় করে সারা শহর ঘুরে বেড়াতেন। সকালে রফিকুল যখন কাজে বেরিয়ে যেতেন ছালমার মন খারাপ হয়ে যেত। রফিকুলও চেষ্টা করতেন তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরার। মাঝে মধ্যে দেরি হলে ছালমা রাগ করতেন রফিকুলের ওপর। নতুন বাসায় ওঠার পর স্থানীয় সাকিবুলের সঙ্গে পরিচয় হয় রফিকুলের। রাস্তায় দেখা হলে কুশল বিনিময় হতো। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে কথাবার্তা হয়। কাজ থেকে ফেরার সময় প্রায়ই দেখা হয় সাকিবুলের সঙ্গে। ঘরে ঢোকার আগে কিছুটা সময় তারা আড্ডা দিতেন বাসার নিচেই। তাদের মধ্যে সম্পর্কটা ঘনিষ্ঠ হতে তাকে। রফিকুলের বাসাতেই মাঝে মধ্যে আড্ডা হতো। রফিকুল তার স্ত্রী এবং সাকিবুল- এই তিনজনের মধ্যেই গল্প-গুজব চলতে থাকে। রফিকুলের পারিবারিক বন্ধু হয়ে ওঠে সাকিবুল। সাকিবুল বয়সে ছোট হলেও রফিকুল তাকে বন্ধুর মতোই জানে। আবার ছোট ভাইয়ের মতোও ¯েœহ করতেন। এক সঙ্গে খাবার খেতে বসলে মাছের বড় টুকরাটা রফিকুল জোর করে সাকিবুলের পাতে তুলে দিতেন। রফিকুলের বাসায় ফিরতে দেরি হলেও বাসায় গিয়ে ছালমার সঙ্গে আড্ডা দিত সাকিবুল। রফিকুল বাসায় ফিরে তাদের আড্ডায় যোগ দিত।

হাসি-খুশির মধ্যেই কাটছিল তাদের দিন। কিন্তু হঠাৎ একটি ঘটনায় তাদের এই হাশি-খুশির জীবন ওলটপালট হয়ে যায়। এক রাতে বাসায় ফিরতে দেরি করে রফিকুল। বাসায় ভীষণ চিন্তিত তার স্ত্রী ছালমা। রাত বাড়তে থাকে। তার চিন্তার মাত্রাও বাড়ে। নির্ঘুম রাত কাটে তার। সাকিবুল বিভিন্ন স্থানে খোঁজ নিয়ে ব্যর্থ হয়। সকালে তাদের আবার খোঁজখবর নেওয়া শুরু হয়। কিন্তু রফিকুলের খবর পান না তারা।

সীতাকুন্ড থানা পুলিশ সেই দিন সকালেই গলা কাটা একটি লাশ উদ্ধার করে। ভাটিয়ারী এলাকায় রেলওয়ে ওভারব্রিজের কাছের একটি লাউ খেত থেকে অজ্ঞাত ব্যক্তিটির গলা কাটা লাশ উদ্ধার করে। লাশটি পুলিশ শনাক্ত করতে পারেনি। কেউ দাবি নিয়েও আসেনি। পুলিশ লোক মারফত জানতে পারে, ভাটিয়ারী এলাকার রফিকুল ইসলামকে আগের রাত থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এতে পুলিশের সন্দেহ হয়। ব্যক্তিটি রফিকুল ইসলামও হতে পারে। এমন সন্দেহ থেকে থানা থেকে পুলিশ পাঠানো হয় রফিকুলের বাসায়।

বেলা বাড়ার পর সীতাকুন্ড থানা থেকে লোক আসে ছালমার বাসায়। ছালমা তখন বাসায় কান্নাকাটি করছিলেন রফিকুলের কোনো খোঁজ না পাওয়ায়। বাসায় পুলিশের উপস্থিতিতে অজানা আশঙ্কায় ছালমার বুক কাঁপে। থানার লোকজন ছালমাকে জানায়, তারা জানতে পেরেছে তার স্বামীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এ কথা শুনে ছালমা জানায়, তার স্বামী আগের রাতে বাসায় ফিরেনি। বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ নিয়েও পাওয়া যায়নি। তারা থানায় খবর দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তখন পুলিশ তাকে বলে, একটি লাশ পাওয়া গেছে। তিনি গিয়ে যেন লাশটি দেখে আসে। এটি তার স্বামীর লাশও হতে পারে। এমন কথা শুনেই আহাজারি শুরু করেন ছালমা। তিনি পুলিশের সঙ্গে থানায় যান। লাশঘরে পড়ে থাকা মৃতদেহের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। চেহারা দেখেই আর্তচিৎকার দিয়ে ওঠেন ছালমা। তার কান্নায় থানার কম্পাউন্ডের বাতাস ভারী হয়ে আসে। সবাই তাকে সান্ত্বনা দেয়। কিন্তু কোনো

সান্ত্বনার বাণী কাজে আসে না। পরে তাকে বাসায় নিয়ে যায়। সেই রাতেই ছালমা অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। ঘটনাটি ২০১৯ সালের ৪ ডিসেম্বরের।

পুলিশ তদন্ত শুরু করে। কিন্তু হত্যা মামলার তদন্তে কোনো অগ্রগতি করতে পারে না পুলিশ। ছালমা তার স্বামীর হত্যার আসামিদের গ্রেফতারের জন্য থানার কর্মকর্তাদের রুমে রুমে ধরনা দিতে থাকেন। কিন্তু পুলিশ খুনের কোনো সূত্র খুঁজে পায় না। এমরান নামে সন্দেহভাজন একজনকে গ্রেফতার করলেও পুলিশ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোনো তথ্য পায় না। এমরানকে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ঘটনার দীর্ঘ আট মাস পর সীতাকুন্ড থানা পুলিশ মামলাটির তদন্তের ভার থেকে নিজেদের সরিয়ে নিতে পুলিশ সদর দফতরে আবেদন জানায়। পুলিশ সদর দফতর এই মামলার তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) দায়িত্ব দেয়। পিবিআই তদন্ত শুরু করে। এদিকে ছালমা তার স্বামীর খুনের আসামিদের গ্রেফতার না হওয়ায় ক্ষুব্ধ হয় পুলিশের ওপর। তিনি তার বাড়ি নাটোরে চলে যান।

পিবিআই দায়িত্ব নেওয়ার পর পেরিয়ে যায় আরও তিন মাস। এরাও তদন্ত করে কোনো কূলকিনারা করতে পারে না। পিবিআইর তদন্ত কর্মকর্তা তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করে। ঘটনার দিন রফিকুলের মোবাইল ফোনে কারা কল করেছিল তা জানার চেষ্টা করে। ৩ ডিসেম্বর রাতে বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর রফিকুল ফিরেনি। সেই রাতে বেশ কয়েকজন তাকে ফোন দিয়েছিল। কয়েকটি সন্দেহজনক নম্বর নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন তদন্ত কর্মকর্তা। এসব নম্বরের মধ্যে একটি নম্বর পুলিশের কাছে খুবই সন্দেহজনক বলে মনে করছে। নম্বরটি সাকিবুল ইসলাম নামে রেজিস্ট্র্রেশন করা। পুলিশের কাছে নামটি খুব পরিচিত মনে হচ্ছিল। পুলিশের হঠাৎ মনে পড়ে রফিকুলের পারিবারিক সেই বন্ধুটির নামও সাকিবুল। পুলিশ সন্দেহ না করলেও চেক করে দেখার জন্য সিদ্ধান্ত নেয়। সন্দেহের মাত্রা বেড়ে যায় পুলিশের। পুলিশ দেখতে পায় এই ব্যক্তির অবস্থান কখনো ঢাকা, কখনো চট্টগ্রাম, ফেনী আবার নাটোরেও। নাটোর জেলার নামটি দেখে পুলিশের মনে এবার সন্দেহ জাগে। নাটোর হলো রফিকুলের বাড়ি। তার স্ত্রী রয়েছেন নাটোরে। তাহলে কি অন্য কোনো কিছু রয়েছে এই খুনের পেছনে? পুলিশের তদন্তে গতি আরও বেড়ে যায়। একটি সূত্র পাওয়া গেছে, হয়তো এই সূত্রের শেষ মাথাতেই খুনের রহস্যের জট আটকে আছে। পুলিশ সাকিবুলের অবস্থান শিয়র হয়ে তাকে পাকড়াও করে। ততদিনে আরও এক মাস পেরিয়ে গেল। ২০২০ সালের ডিসেম্বর শুরুতেই সাকিবুলকে গ্রেফতারের পর জেরা করে পুলিশ। সাকিবুল বুঝতে পারে, আর রক্ষা নেই। তিনি বলেন, খুন করেছে ভাড়াটে কিলার এমরান। সঙ্গে তিনিও ছিলেন। আর মূল পরিকল্পনাকারী রফিকুলের স্ত্রী ছালমা। পুলিশ হতবাক। বলে কি? স্ত্রী ছালমা পরিকল্পনাকারী। যে নারী তার স্বামীর হত্যার বিচারের জন্য থানা পুলিশ আর আদালতের বারান্দায় ঘুরেছে, সে কি না খুনি? পুলিশের বিশ্বাস হতে চায় না। তারা আরও তদন্ত করতে চায়। ভাড়াটে কিলার এমরান একই মামলায় গ্রেফতার হয়ে আগে থেকেই কারাগারে রয়েছে। কিন্তু সীতাকুন্ড থানা পুলিশ তার কাছ থেকে কোনো তথ্য পায়নি। পিবিআই এমরানকে রিমান্ডে নিয়ে এসে জেরা করে। এমরানের তথ্যও একই। সাকিবুলের তথ্যের সঙ্গে এমরানের তথ্যে হুবহু মিল রয়েছে। পুলিশ নিশ্চিত খুনির পরিকল্পনাকারী স্ত্রী ছালমা।

পুলিশ নাটোরে গিয়ে গ্রেফতার করে নিয়ে আসে ছালমাকে। পুলিশের জেরায় সাকিবুল জানায়, ছালমার সঙ্গে তার অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। রফিকুলের উদারতার দুর্বলতা নিয়ে সাকিবুল ছালমার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে। রফিকুল যখন কাজে বাইরে যেতেন, তখনই ঘরে ঢুকে পড়তেন সাকিবুল। সারা দিন তারা এক সঙ্গে থাকতেন। রফিকুল বাসায় ফিরার আগে বেরিয়ে যেতেন সাকিবুল। বিকালে আবারও আড্ডা দিতে আসতেন রফিকুলের সামনেই। এভাবেই এক সময় সন্দেহ করতে থাকে রফিকুল। এ নিয়ে মনোমালিন্য শুরু হয়। মারধরও করেছেন রফিকুল। এরপরই ছালমা আর সাকিবুল দুজনে মিলে রফিকুলকে হত্যার পরিকল্পনা আঁটে। ছালমা ৩০ হাজার টাকা দেয় সাকিবুলকে খুনি ভাড়া করতে। ঘটনার রাতে পরিকল্পনা অনুযায়ী সাকিবুল ফোন করে রফিকুলকে ডেকে নিয়ে আসে। ভাটিয়ারী এলাকায় রেলওয়ে ওভারব্রিজের কাছেই রফিকুলকে ধরে গলা কেটে হত্যা করে। পাশেই একটু অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ছিল ছালমা। খুন নিশ্চিত করতেই ঘটনাস্থল পর্যন্ত ছিল ছালমা। পরে লাশ একটি লাউ খেতে ফেলে রাখে। ঘটনাটি ভিন্ন খাতে দিতে ছালমা নিজেই বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। পুলিশ যখন রহস্য খুঁজে পায় না, ছালমা সাকিবুল ভীষণ খুশি। নাটোরে গিয়ে সাকিবুল ছালমার সঙ্গে মিলত। তারা ভেবেছিল তাদের সুখের জীবন হয়তো শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু সুখ নয়, তারা এখন চার দেয়ালে বন্দী। হয় তারা সারাটা জীবন কারাগারেই থাকবে। নয়তো ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে হবে তাদের তিনজনকেই।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর