বুধবার, ২৫ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

বন্যায় আতঙ্কিত মানুষ সংকট সুপেয় পানির

মানিকগঞ্জে পানি বাড়ছে, ভাঙন আতঙ্কে তীরবর্তী মানুষ

নিজস্ব প্রতিবেদক

বন্যায় আতঙ্কিত মানুষ সংকট সুপেয় পানির

দিন দিন বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন নিম্নাঞ্চলের মানুষ। খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে রয়েছেন তারা। সেই সঙ্গে বন্যার পাশাপাশি বাড়ছে নদী ভাঙনও। তলিয়ে যাচ্ছে বসতভিটাসহ নিম্নাঞ্চল। ফরিদপুরে ২০ হাজার, রাজবাড়ীতে ৭ হাজারসহ পাবনা, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর ও কুড়িগ্রাম জেলায় প্রায় লাখ মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছেন।

এদিকে পদ্মা, যমুনা, গড়াই, আত্রাই ও ধলেশ্বরী পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বিভিন্ন নদীতে ৬৮ পয়েন্টে পানি বেড়েছে; কমেছে ৩৮ পয়েন্টে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় পাবনা, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর ও শরীয়তপুরের বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতি হতে পারে। আগামী ২৪/৪৮ ঘণ্টায় তিস্তার ডালিয়া ও সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে পানি বাড়তে পারে। গতকাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের  বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।

ফরিদপুরে ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দী : ফরিদপুরে এক সপ্তাহ ধরে পদ্মার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। সেই সঙ্গে দেখা দিয়েছে তীব্র ভাঙন। জেলা সদর, চরভদ্রাসন, সদরপুর ও ভাঙ্গা উপজেলার ফসলি খেত, রাস্তা ও নিচু এলাকার বসতবাড়ি তলিয়ে গেছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে দেড় শতাধিক গ্রামের মানুষ। সেই সঙ্গে সুপেয় পানি ও গবাদি পশুর খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে।

ফরিদপুর জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় পদ্মা নদীর পানি ৩ সেন্টিমিটার বেড়ে এখন তা বিপৎসীমার ৫৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে ফরিদপুর সদর উপজেলার নর্থ চ্যানেল, ডিক্রিরচর, চরমাধবদিয়া ও আলিয়াবাদ ইউনিয়নের নতুন নতুন গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া সদরপুর ও চরভদ্রাসন উপজেলার চারটি ইউনিয়নের বেশ কিছু গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। মধুমতি নদীর পানি বৃদ্ধির ফলে আলফাডাঙ্গা উপজেলার নদী তীরবর্তী বেশ কয়েকটি গ্রামে বন্যা দেখা দিয়েছে। ফরিদপুর সদর উপজেলার নর্থচ্যানেল ইউনিয়নে নতুন করে প্লাবিত হয়েছে সামাদ মল্লিক ডাঙ্গী, রফিক মুন্সীর ডাঙ্গী, আকবর মীর মালতের ডাঙ্গী, চর ধুলাই ডাঙ্গী, আদম মোল্যার ডাঙ্গী, জয়নাল মাতুব্বরের ডাঙ্গী, সোনা মোল্যার ডাঙ্গী, নজর আলী মাতুব্বরের ডাঙ্গী। এ ছাড়া নতুন করে পদ্মার ভাঙন শুরু হয়েছে শুকুর আলী মুন্সীর ডাঙ্গী। বন্যার কারণে ফরিদপুর জেলার ১২টি ইউনিয়নের কমপক্ষে ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে এসব এলাকার অসহায় মানুষের মাঝে আহাজারি বাড়ছে। স্থানীয়ভাবে বন্যার্তদের মাঝে কিছু এলাকায় শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে।

পানি কমলেও আতঙ্ক কাটেনি : ‘দুই দিন থাকি নদীত পানি কমছে। কিন্তুক বিড়ম্বনা কমে নাই। নদী ভাঙতে আছে। এ্যলাও নিচ্যা জাগাত (নিম্নাঞ্চল) হাঁটুপানি। এমন অবস্থাত থাকা দায়। হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল নিয়্যা (নিয়ে) বেশি যন্ত্রণা। আবাদি জমি পানিত তলে আছে। আমনের খেত নষ্ট হইছে, আর আবাদ হবার নায়। এ্যলা তো দেওয়া ম্যাঘ (আকাশ অন্ধকার) করলে ভয় নাগে। টানা ঝড়বৃষ্টি হইলে বানোতে সোগ (বন্যায় সব) ভাসি যাইবে।’ পরিবার নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে যাওয়ার পথে কথাগুলো বলছিলেন পঞ্চাশোর্ধ্ব আজিরন বেওয়া। তিনি থাকেন লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার ইউনিয়নের চর গোবর্ধনে। আজিরনের ভাষ্য, নদীর পানি কমলেও ভাঙন কমেনি। এখনো হাঁটুপানিতে রাস্তা-ঘাট, আবাদি জমিসহ ধান ও পাটের খেত তলিয়ে আছে। এ ছাড়া তিস্তার পানি গ্রামে ঢুকে পড়ায় কয়েক হাজার মানুষ পরিবার নিয়ে পানিবন্দী রয়েছে। অনেকের ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীনও হয়েছে। এ কারণে ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে আশ্রয়ের খোঁজে বের হয়েছেন।

মানিকগঞ্জে পানি বাড়ছে : মানিকগঞ্জের আরিচা পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি স্থিতিশীল থাকলেও জেলার অভ্যন্তরীণ ধলেশ্বরী কালীগঙ্গা, গাজীখালি ও ইছামতী নদীর পানি বাড়ছে। এ কারণে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। নদীতীরবর্তী এলাকায় শুরু হয়েছে ভাঙন। যমুনা নদীর পানি এখনো বিপৎসীমার পাঁচ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যমুনা নদীর পানি ড্রেনের মাধ্যমে প্রবেশ করে নতুনপাড়া গ্রামের শতাধিক বাড়ির আঙিনা তলিয়ে গেছে। চলাচলের সড়কেও উঠেছে পানি। এসব অভ্যন্তরীণ রাস্তায় ছোট যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু নৌকা চলার উপযোগী পানি না হওয়ায় লোকজন পড়েছে বিপাকে। এদিকে আরিচা ফেরিঘাট এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে।

যমুনার পানি স্থিতিশীল : যমুনার পানি বাড়ায় সিরাজগঞ্জে নদী তীরবর্তী ও নিম্নাঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে। গত ২৪ ঘণ্টা ধরে যমুনা নদীর পানি স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। পানি ১৩.৩২ সে.মি. লেভেলে প্রবাহিত হচ্ছে। যা বিপৎসীমার ৩ সে.মি. নিচে রয়েছে। তবে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে কয়েক হাজার পরিবার। নিম্নাঞ্চলের বসতভিটায় পানি ওঠায় অনেক ওয়াপদা বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে।

রাজবাড়ীতে বাড়ছে পদ্মার পানি : রাজবাড়ীর পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এতে করে পানিবন্দী মানুষের সংখ্যা বেড়ে চলছে। গত ২৪ ঘণ্টায় রাজবাড়ীর পদ্মা নদীর পানি ২ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৫৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে করে রাজবাড়ী গোয়ালন্দ উপজেলার পানিবন্দী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। জেলায় সাড়ে ৭ হাজার মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে বলে জানা গেছে।

ভাঙনে সাইক্লোন শেল্টার বিলীন : ঝালকাঠির বিষখালী নদীর আকস্মিক ভাঙনের সদর উপজেলার দেউরী সাইক্লোন শেল্টার কাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুটি শ্রেণি কক্ষ ও একটি মসজিদ বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনের নিচে চাপা পড়ে স্থানীয় আফছার মেমোরিয়ার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ১০ শ্রেণির ছাত্র নেয়ামতুল্লা নিখোঁজ এবং অপর একজন আহত হয়েছে।

স্রোতে ফেরি চলাচল ব্যাহত : পদ্মায় পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় পদ্মা নদীর পানি গোয়ালন্দ পয়েন্টে ২ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৫৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।

 রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে তীব্র স্রোতে ফেরি চলাচল চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এতে করে দৌলতদিয়া প্রান্তে পারাপারের অপেক্ষায় রয়েছে শত শত যানবাহন। দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে এসব যানবাহনকে ফেরির নাগাল পেতে হচ্ছে। রাজবাড়ী-কুষ্টিয়া আঞ্চলিক মহাসড়ক ও ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে সৃষ্টি হয়েছে যানজট।

পাবনায় দ্রুত বাড়ছে নদীর পানি, প্লাবিত নিম্নাঞ্চল : টানা বর্ষণ আর উজানের ঢলে পাবনায় পদ্মা ও যমুনা নদীর পানি দ্রুত বাড়ছে। এরই মধ্যে যমুনার পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে এবং পদ্মার পানি বিপৎসীমার কাছাকাছি প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া জেলার অভ্যন্তরীণ ইছামতী, হুরাসাগর, গুমানি, চলনবিলসহ বেশ কিছু নদ-নদীর পানিও বেড়েছে। স্থানীরা জানান, জেলায় পদ্মা ও যমুনার তীরবর্তী নিচু এলাকা প্লাবিত হয়ে পানিবন্দী হাজারো মানুষ। তলিয়ে গেছে রাস্তাঘাট ও ফসলি জমি।

সর্বশেষ খবর