বৃহস্পতিবার, ২৬ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

দুশ্চিন্তা দারিদ্র্য বিমোচন ও কর্মসংস্থানে

দুই বছর ধরে চলা করোনা ভয়াবহতায় অন্তত ৩০ শতাংশ মানুষ কাজ হারিয়েছেন

মানিক মুনতাসির

সর্র্বশেষ সরকারি হিসাব অনুযায়ী দেশে করোনা মহামারী শুরুর আগে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৭ লাখ। আর কাজের মধ্যে ছিলেন ৬ কোটি ৮ লাখ মানুষ। এ তথ্য অবশ্য অবিশ্বাস্য বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এদিকে প্রায় দুই বছর ধরে চলা করোনা ভয়াবহতায় অন্তত ৩০ শতাংশ মানুষ কাজ হারিয়েছেন। একই সঙ্গে ৭০ শতাংশ মানুষের আয় কমেছে। আলোচ্য করোনা মহামারীর আগে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ২০ শতাংশ। বর্তমানে তা হয়েছে ৪০ শতাংশ। অবশ্য বেসরকারি হিসাবে এর সংখ্যা আরও বেশি বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। আর আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বলছে, দেশের তরুণদের মধ্যে অন্তত ২৫ শতাংশই বেকার। সংস্থাটির হিসাবে মোট বেকারের সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি।

তবে গত দুই বছরে দেশের অভ্যন্তরে কত সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। এদিকে গত তিন বছরে কাজের জন্য বিদেশে গেছেন প্রায় ১১ লাখ কর্মী। অথচ (২০১৯, ২০২০, ২০২১ সময়ে) টার্গেট ছিল ৩০ লাখ মানুষকে বিদেশে পাঠানোর। গত দুই বছরে সরকারি-বেসরকারিভাবে ১ লাখেরও কম মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে, যেখানে স্বাভাবিক সময়ে প্রতিবছর অন্তত ৭ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান (চাকরি) হয় সরকারি-বেসরকারি খাতে। বাকি থাকা বিপুলসংখ্যক কর্মক্ষম মানুষের একটা অংশ উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বাকি থাকাদের বেশির ভাগই অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। কিংবা বেকার থেকে যান। সরকারি ভাষায় এদের অবশ্য স্বেচ্ছাবেকার বলা হয়। কেননা এদের বেশির ভাগই উচ্চশিক্ষিত হওয়ায় সন্তোষজনক পদ না পাওয়ায় চাকরি কিংবা কাজে যোগ দেন না।

উপরের এই পরিসংখ্যান দেখলে সহজেই বোঝা যায়, স্বাভাবিক সময়ে প্রতিবছর কত সংখ্যক মানুষ বেকার থাকে। আর করোনা মহামারীতে এই বেকারের আঘাত কতটা ঘনীভূত হয়েছে। আবার অন্যদিকে দারিদ্র্যের হার হয়েছে দ্বিগুণ। ফলে বর্তমানে দেশে কয়েক কোটি মানুষ বেকার অবস্থায় রয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। আবার ৮ কোটিরও বেশি মানুষ দরিদ্র।

এদিকে সরকারি-বেসরকারি পরিসংখ্যানের তথ্যমতে, প্রতিবছর কর্মক্ষমদের তালিকায় যোগ হচ্ছে ১৮ থেকে ২১ লাখ তরুণ-তরুণী। স্বাভাবিক অবস্থায় সেখান থেকে সরকারি-বেসরকারি চাকরি পান ৬ থেকে ৮ লাখ। অর্থাৎ প্রতিবছর প্রায় ১৫ লাখ মানুষ বেকারের তালিকায় নাম লেখান, যাদের বেশির ভাগই শিক্ষিত তরুণ। এদের অধিকাংশই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে বের হন কিন্তু সময়মতো কাজ পান না। ফলে দেশে বেকারের বোঝা বাড়ছে প্রতিনিয়তই। জানা গেছে, সর্বশেষ ২০১৭ সালে প্রকাশিত শ্রমশক্তি জরিপের

 তথ্যমতে, ২০১৭ সালের হিসাবে, তখন দেশে ৬ কোটি ৮ লাখ লোক কাজের মধ্যে ছিলেন, ২০১৩ সালে যা ছিল ৫ কোটি ৮১ লাখ। এর মানে, ওই চার বছরে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে ২৭ লাখ। অর্থাৎ বছরে গড়ে পৌনে ৭ লাখ নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। অথচ প্রতিবছর অন্তত ১৮-২১ লাখ মানুষ কর্মক্ষম হন, যাদের সবারই কর্মবাজারে প্রবেশ করার কথা। কিন্তু সুযোগ না থাকায় তা হয় না। এদিকে করোনায় বিদেশে কর্মী পাঠানোর মেয়াদি পরিকল্পনায় ধস নেমেছে। বর্র্তমান সরকারের ২০১৮ সালের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তিন বছর মেয়াদি পরিকল্পনায় আছে- ২০১৯, ২০২০ ও ২০২১ সালের মধ্যে ২১ লাখ কর্মী বিদেশে পাঠানো হবে। এখন পর্যন্ত আড়াই বছরে বিদেশ গেছেন প্রায় ১১ লাখ কর্মী। সে হিসাবে বাকি চার মাসে পাঠাতে হবে ১০ লাখ কর্মী। কর্মী পাঠানোয় এমন ধস নামার অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে করোনাভাইরাস মহামারীকে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ব্র্র্যাক ও পিপিআরসি বলছে, জুলাই শেষে দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৪০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, যা ২০০৯ সালের ডিসেম্বর শেষে ছিল ২০ শতাংশ। আর ২০১৬ সালে এটা ছিল ২৪ শতাংশ। সেখানে চার বছরে দরিদ্র কমেছিল চার শতাংশ। আর গত ডিসেম্বর-জুলাই সাত মাসে দারিদ্র্যের হার দ্বিগুণ হয়েছে। কভিড-১৯ পরিস্থিতি আরও দীর্ঘায়িত হলে দারিদ্র্যের হার আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কভিডের কারণে দারিদ্র্য বাড়ছে। এটা তো শুধু বাংলাদেশে নয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও একই পরিস্থিতি। কভিডের আগে দারিদ্র্য বিমোচনে বাংলাদেশ বেশ ভালো করছিল। কিন্তু কভিডের ধাক্কায় সে অবস্থা আর নেই। এখন মানুষের আয় কমে গেছে। বহু মানুষ নতুন করে বেকার হচ্ছে। আগের বেকার সমস্যা তো রয়েছেই। ফলে দারিদ্র্যের হার বাড়ছে। সূত্রমতে, করোনার মহামারীর কারণে প্রতিনিয়তই কমছে মানুষের আয়। বাড়ছে দৈনন্দিন ব্যয়। ফলে সঞ্চয় ভাঙিয়েও চলতে পারছে না মানুষ। নিম্ন, নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ প্রতিনিয়ত গচ্ছিত সম্পদ বিক্রি করছে। আর এই জনগোষ্ঠীর একটি অংশ প্রতিনিয়ত ধারদেনা করছে জীবনধারণের জন্য। বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার জরিপ বলছে, কভিডের কারণে বেশির ভাগ মানুষেরই আয় কমেছে। দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাচ্ছে মানুষ। আর ধনী ও বণিক শ্রেণির মানুষের আয় কমেছে যৎসামান্য। ফলে ধনী-গরিবের মধ্যে বৈষম্যও বাড়ছে দ্রুত।

এ প্রসঙ্গে ব্র্যাকের চেয়ারম্যান ড. হোসেন হোসেন জিল্লুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সামগ্রিকভাবে মানুষের আয় কমেছে। তবে সবচেয়ে বেশি কমেছে নিম্ন আয়ের তথা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের মানুষের। এ জন্যই মূলত দারিদ্র্যের হার বাড়ছে। করোনা পরিস্থিতি যেহেতু দীর্ঘায়িতই সেহেতু দারিদ্র্যের এই হার আরও বাড়বে। কিন্তু মুশকিল হলো, এ পরিস্থিতি সামনে কতটা দীর্ঘায়িত হবে তা এখনো বলা যাচ্ছে না নির্দিষ্ট করে। ফলে শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বজুড়েই দারিদ্র্যের হার আরও বাড়বে বলে তিনি মনে করেন। এ ছাড়া সরকারের যে দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি ছিল, সেটিও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে নানা কারণে। ফলে সরকারের সামনে জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষার পরই এখন সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা হিসেবে দেখা দিয়েছে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র্য বিমোচন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর