বৃহস্পতিবার, ২৬ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

ডাকাত নয়, খুনি স্ত্রী

মির্জা মেহেদী তমাল

ডাকাত নয়, খুনি স্ত্রী

রাত ৪টা ৪১ মিনিট। ওসির মোবাইল বেজে ওঠে। ঘুম চোখেই ফোন রিসিভ করলেন। হ্যালো কে বলছেন। ওপাশ থেকে অজ্ঞাত ব্যক্তি বলেন, স্যার, পৌরসভার এক বাসায় ডাকাতি হয়েছে। বাসার গৃহকর্তা ডাকাতদের হাতে খুন হয়েছেন এবং গৃহকর্ত্রী ডাকাতের ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত। তাকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। রাতে এত ঘটনা? পুলিশ তখনো  জানে না!

কিছু সময় আগেই ওসি থানার টহল ডিউটি তদারকি করে ফিরেছেন বাসায়। এই অল্প সময়ের মধ্যেই এতকিছু! থানার সব টহল দলকে তিনি নির্দেশনা দেন ঘটনাস্থলে দ্রুত যেতে। নিজেও ছুটে যান ঘটনাস্থলে। ঘরে খাটের ওপর পড়ে আছে গৃহকর্তার নিথর দেহ। বুকে পাঁচটি ধারালো ছুরির আঘাতের চিহ্ন। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়ে বিছানা গেছে ভিজে। পাশেই পড়ে আছে রক্তাক্ত ছুরি। ছোট্ট তিনটি শিশু সন্তান কাঁদছে বাবার মৃত দেহ দেখে। উপস্থিত লোকজন হা-হুতাশ করছে, কেউবা শোকে কাঁদছে অঝোরে। গৃহকর্তা মাহবুবুর রহমান          (৩৮) কমলাপুর রেলস্টেশনের একজন কর্মচারী। থাকেন তেজগাঁও এলাকায় ব্যাচেলর বাসায়। বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক বন্ধ থাকায় ভৈরব পৌরসভার চ-ীবের উত্তর পাড়ায় নিজ বাসায় পরিবারের কাছে যেতেন প্রতি বুধবার সন্ধ্যায়। শুক্রবার ভোরে ফিরে যেতেন কর্মস্থলে। ছেলে আজিজুল (১০) ৪র্থ শ্রেণির ছাত্র, সামিউল (৭) প্রথম শ্রেণির ছাত্র এবং মেয়ে সাদিয়া (৩) ছোট। মাহবুবুর রহমানের প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয় ২০০৪ সালে। সে সংসারে কোনো সন্তান ছিল না। ২০০৮ সালে পারিবারিকভাবে বিয়ে করেন নরসিংদী জেলার বেলাবো থানার ইব্রাহিমপুর গ্রামের রোখসানাকে। সুখের সংসারে তিন সন্তান নিয়ে তাদের ভালোই কেটে যাচ্ছিল সময়। কিন্তু অকল্পনীয় এমন দুর্ঘটনায় তাদের সব স্বপ্ন ভেঙে যায়। অবুঝ তিনটি শিশুর ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত আত্মীয়-স্বজন। ২০১৯ সালের ঘটনা এটি। অন্য সপ্তাহের মতো ২৭ নভেম্বর সন্ধ্যার পর বাসায় আসেন মাহবুবুর রহমান। রাত সাড়ে দশটার দিকে ঘুমিয়ে যান তিনি। রাত চারটার পর পুলিশ সংবাদ পেয়ে যখন ঘটনাস্থলে আসেন তখন বাড়ি ভর্তি স্থানীয় লোকজন। ঘটনাস্থল ঘরের কোনো মালামাল নেই এলোমেলো, ঘরের দরজা জানালা আছে অক্ষত। ডাকাতের ব্যবহৃত ছুরি ব্যতীত নেই অন্য কোনো আলামত। দক্ষ ওসি মো. শাহীন খুঁজতে থাকেন নানা প্রশ্নের জবাব। কিন্তু উত্তর জিনি দেবেন তিনি আছেন ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। গৃহকর্ত্রী রোখসানার কাছ থেকে সেসব প্রশ্নের উত্তর জানতে ছুটে যান হাসপাতালে। অসুস্থ রোখসানা কিছু প্রশ্নের উত্তর দেন, কিছু প্রশ্ন এড়িয়ে যান। কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। ততক্ষণে ওসির সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়েছে। ডাক্তারের পরামর্শে উন্নত চিকিৎসার জন্য রোখসানাকে রেফার করা হয় বাজিতপুরের জহিরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। কৌশলে নিরাপত্তার কথা বলে রোখসানাকে নজরদারি করার জন্য দুজন নারী ও একজন পুরুষ পুলিশ দেওয়া হয় তার সঙ্গে। চিকিৎসা ও নজরদারিতে থাকে রোখসানা। অবস্থা বিবেচনায় ওসি মাহবুবুরের লাশের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করেন এসআই মতিউজ্জামান। এরপর ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয় মর্গে। সারা দিন চলে চুলচেরা বিশ্লেষণ। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকের কাছ থেকে পেয়ে যান কিছু তথ্য। বিশ্বস্ত একাধিক সোর্স এবং তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় ঘটনা সম্পর্কে পেয়ে যান কিছু ধারণা। 

২৮ নভেম্বর রাতে মাহবুবুর রহমানের ভাই হাবিবুর রহমান অভিযোগকারী হিসেবে দায়ের করেন অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা। মামলা নম্বর- ৬০। নজরদারির আওতায় চলে আসে আরও কয়েকজন। ঘুম নেই তদন্তকারী অফিসার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) বাহালুল খান বাহারের চোখে। নানান তথ্য সন্নিবেশিত করে আগাতে থাকেন মূল ঘটনার দিকে। ৩০ নভেম্বর গ্রেফতার করা হয় রোখসানাকে। নিবিড় জিজ্ঞাসাবাদে বের হয়ে আসে ঘটনার মূল রহস্য। তার দেওয়া তথ্য মতে গ্রেফতার করা হয় নজরদারিতে থাকা দেবর আসিফ আহম্মেদকে (১৯)। রান্না ঘর থেকে উদ্ধার করা হয় ঘটনায় ব্যবহৃত ঘুমের ওষুধ মেশানো প্লাস্টিকের বোতল এবং ঘুমের ওষুধের খোসা। আর আসিফের দেওয়া তথ্যে কচু খেত থেকে উদ্ধার করা হয় ঘটনার সময় আসিফের গায়ে থাকা রক্তমাখা শার্ট ও প্যান্ট। পয়লা ডিসেম্বর উভয় আসামি বিজ্ঞ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করে জানিয়েছেন ঘটনার আদ্যোপান্ত। আসিফ আহম্মেদ স্থানীয় কলেজে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র। সম্পর্কে মাহবুবুর রহমানের আপন চাচাত ভাই। সে হিসেবে অপর আসামি রোখসানার দেবর। পাশাপাশি ঘরে বসবাস করায় তাদের মধ্যে ছিল অবাধ দেখাশোনা হওয়ার সুযোগ। মাহবুবুর রহমান সপ্তাহের ছয় দিন বাড়ির বাইরে থাকায় তাদের মধ্যে সম্পর্ক হতে থাকে ঘনিষ্ঠ। একসময় এ সম্পর্ক মন থেকে শরীরে গড়ায়। দুজন দুজনার প্রেমে মশগুল হয়ে যায় দিন দিন। রোখসানা ভালোবেসে তার বিয়ের গয়না বিক্রি করে নগদ ১ লাখ টাকাও দেয় আসিফকে বিদেশে যাওয়ার জন্য। এ ছাড়াও প্রায়ই সময় বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন অঙ্কের টাকা দিতে থাকেন আসিফকে। নিজের তিন সন্তানের ভবিষ্যৎ এবং সামাজিক সব বাধা উপেক্ষা করে অসম প্রেমে তারা যখন হাবুডুবু খাচ্ছিলেন, তখনই মাথায় আসে এক কুবুদ্ধির হাতছানি। রোখসানা ইদানীং তার স্বামী মাহবুবুর রহমানকে দেখতে পারেন না। মাহবুব বাসায় এলেই তার অস্বস্তি লাগে। সুখের সংসারে নিয়মিত ঝগড়া এবং আলাদা বিছানায় রাতযাপন। মাহবুব হয়তো বিষয়টি আঁচ করতে পারেননি বা আঁচ করলেও বুঝতে পারেননি ঘটনার মূল রহস্য। তবুও মাহবুবুর রহমান স্ত্রীর মন রক্ষা করতে প্রতি বুধবার ছুটে যেতেন নিজ বাড়িতে। রোখসানা এবং আসিফ এবার ছক আঁটে নতুন পরিকল্পনায়। তাদের অসম প্রেমের একমাত্র অন্তরায় মাহবুবকে সরিয়ে দিতে হবে পৃথিবী থেকে। দুজনই সম্মত হয় এ সিদ্ধান্তে। প্রথম চেষ্টা হিসেবে ঘটনার দুই সপ্তাহ আগে আসিফ ২০টি ঘুমের ওষুধ পানিতে গুলিয়ে বোতলে করে দিয়ে যায় রোখসানার কাছে। বুধবার বাসায় এলে রাতে কফির সঙ্গে মিশিয়ে রোখসানা সেই ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দেয় স্বামী মাহবুবকে। রাতে প্রচুর নাক ডেকে ঘুমালেও সকালে ঘুম থেকে উঠে যায় মাহবুব। এ যাত্রা ভেস্তে যায় হত্যার পরিকল্পনা, বেঁচে যায় মাহবুব। দীর্ঘ ১২ বছরের সংসারে স্ত্রী তাঁকে মেরে ফেলবে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি সহজ-সরল মাহবুব। যথারীতি তিনি ভালোবেসে যান তার স্ত্রীকে। এর পরের সপ্তাহে একইভাবে বাসায় এলেও এবার ছিল না কোনো পরিকল্পনা। সুস্থ মতো ফিরে যান কর্মস্থলে।

২৭ নভেম্বর বুধবার বাসায় আসার আগেই রোখসানা এবং আসিফ আবার পরিকল্পনা করে মাহবুবকে হত্যার। ১০টি ঘুমের ওষুধ কিনে আনে রোখসানা আর ২০টি আনে আসিফ। ৩০টি ট্যাবলেট একসঙ্গে গুঁড়া করে একটি প্লাস্টিকের বোতলে পানিতে গুলিয়ে আসিফ দিয়ে যায় রোখসানার কাছে। স্বামী মাহবুব বাসায় এসে স্ত্রীর হাতে খেতে চায় সুস্বাদু পায়েস। ঘুমের ওষুধ মেশানোর মাধ্যম পেয়ে যায় রোখসানা। রাতের খাবার শেষে পায়েস রান্না করে স্বামীর পায়েসের পেয়ালায় মিশিয়ে দেয় ঘুমের ওষুধ মেশানো পানি। এবার পায়েস খেয়ে গভীর অচেতন ঘুমে মাহবুব। ছেলে-মেয়েরা যায় ঘুমিয়ে। আসিফকে মেসেজে জানায় অবস্থা। রাত সাড়ে এগারোটার দিকে আসিফ আসে বাসায়। অবস্থা দেখেশুনে আবার ফিরে যায়। রাত সাড়ে বারোটায় আবার আসে আসিফ। এবার পরিকল্পনার ছক আঁকে দুজন। বালিশ চাঁপা দিয়ে হত্যা করা হবে মাহবুবকে। তারপর বলা হবে হার্ট অ্যাটাক হয়ে মারা গেছে মাহবুব। তবে কোনো কারণে মাহবুব জেগে উঠলে প্রতিহত করা হবে ছুরি দিয়ে। বাসায় থাকা ছুরি এগিয়ে দেয় রোখসানা। তবে ছুরি দিয়ে আঘাত না করার পক্ষে রোখসানা। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষার কথা বলে ফিরে যায় আসিফ।

রাত তিনটার দিকে ফোনে কথা বলে আবার আসে আসিফ। বারান্দা থেকে দুজনে কাপড় শুকানোর রশি এনে কম্বল পেঁচিয়ে মাহবুবের পা বেঁধে ফেলে। নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিল মাহবুব। এরপর আসিফ মাহবুবের বুকের ওপর উঠে বসে। রোখসানা বসে পেটের ওপর। মুখে বালিশ চাপা দিলে অচেতন অবস্থায়ই মাহবুব বালিশ সরিয়ে বলে ওঠে ‘কেরে?’ ততক্ষণে আসিফ বুঝে নেয় তাকে চিনে ফেলেছে মাহবুব। সজোরে আঘাত করে বুকে ছুরি দিয়ে। তিনটি আঘাত করলে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয় শরীর থেকে। চতুর্থবার আঘাত করতে গেলে বাধা দেয় রোখসানা। ডান হাত কেটে যায় তার। আরও দুটি আঘাত করে মৃত্যু নিশ্চিত করে। দুজনের পরিকল্পনা তখন পরিবর্তন হয়। ডাকাত এসে হত্যা করে গেছে বলে প্রচার চালানোর উদ্যোগ নেয় তারা। পরিহিত রক্তমাখা কাপড় ফেলে দিয়ে গোসল করে পরিষ্কার হতে বের হয়ে যায় আসিফ। মাদরাসার পাশে কচু খেতে লুকিয়ে রাখে রক্তমাখা প্যান্ট ও শার্ট। এরপর খবর রটে দেওয়া হয় ডাকাতির ঘটনার।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর