রবিবার, ২৯ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

করোনাকালে চলে গেছেন শতাধিক বুদ্ধিজীবী

শূন্যতা সহজে পূরণ না হওয়ার শঙ্কা

শফিকুল ইসলাম সোহাগ

করোনাকালে চলে গেছেন শতাধিক বুদ্ধিজীবী

করোনা মহামারীতে বাংলাদেশে গতকাল পর্যন্ত ২৫ হাজার ৯২৬ জন মারা গেছেন। শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, চিকিৎসক, পুলিশ, সেনা সদস্য, ব্যবসায়ী, আমলা, ব্যাংক কর্মকর্তা, দুদক কর্মকর্তা, সাংস্কৃতিক অঙ্গনের লোক- কেউ বাদ যাননি করোনায় মৃত্যুর হাত থেকে। দেড় বছরে দেড় শতাধিক বুদ্ধিজীবী যারা গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, সুশাসন ও দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়ার জন্য আজীবন লড়াই করেছেন তারা চলে গেছেন না-ফেরার দেশে। ভবিষ্যতের দিকে চোখ রাখা বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনায় জ্ঞানের বাতিঘর, আলোকবর্তিকা বিশেষ করে বুদ্ধিজীবীশূন্য হয়ে যাচ্ছে দেশ। এ শূন্যতা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। এভাবে চলতে থাকলে দেশ বুদ্ধিজীবী সংকটের মুখোমুখি হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এ মহামারীতেও আমরা বহু মানুষকে হারিয়েছি, যাঁরা সমাজকে বহুদিন ধরে নেতৃত্ব দিয়ে অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেছেন। একসঙ্গে তাঁদের বিদায় নেওয়াটা স্বাভাবিকভাবেই দেশের জন্য বড় ধরনের একটি শূন্যতা তৈরি করেছে। এ শূন্যতা সহজে আমরা পূরণ করতে পারব বলে মনে হয় না। এখন অনুসরণ করার মতো কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না। এজন্য নিজেদের দুর্বল মনে হয়।’ তিনি বলেন, ‘টিকা কার্যক্রমে প্রবীণদের অগ্রাধিকার দিয়ে শতভাগ মানুষকে আওতায় আনতে হবে। নবীনদের মতো প্রবীণরাও রাষ্ট্রের সম্পদ। প্রবীণদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে নবীনরা দেশ সামনে এগিয়ে নেবে। সমাজের অভিভাবকদের রক্ষার জন্য পৃথিবীর অনেক দেশ নানা কৌশল গ্রহণ করেছে। আমাদেরও তাদেরসহ সবাইকে বাঁচাতে হবে।’

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনাভাইরাসের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে বয়স্কদের ওপর। দেড় বছরে ভাইরাস ছোবলে প্রিয় ও আলোচিত মুখ অনেকেই নীরবে হারিয়ে গেছেন। যাঁরা ছিলেন নিজ নিজ ক্ষেত্রে উজ্জ্বল নক্ষত্র। এত বুদ্ধিজীবীর একসঙ্গে চলে যাওয়া দেশের জন্য বড় সমস্যা। কারণ তাঁরা সব সময় দেশের কল্যাণে কাজ করেছেন। তাঁদের চিন্তা, গবেষণা বা কথা জাতিকে সঠিক পথ দেখিয়েছে। সচেতন মহল মনে করছে, আজ বাংলাদেশটা রোগাক্রান্ত। চারদিকে দুর্নীতি, নানান ভয়, নির্যাতন, অত্যাচার ও অনিয়মের খবরে বেদনার শেষ নেই সমাজের। এদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার জন্য যে মানুষগুলো দরকার ছিল তাঁদের শূন্যতায় এখন কে দেখাবে আলোর পথ? তাঁরা বলছেন, এখন পর্যন্ত যেসব আলোকিত মানুষ চলে গেছেন সে অর্থে দেশ কাউকে সৃষ্টি করতে পারেনি।

করোনাকালে গত দেড় বছরে করোনা ও অন্যান্য রোগে জাতি যাঁদের হারিয়েছে তার মধ্যে আছেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, লেখক ও জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ; বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকতা, সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ইতিহাস কামাল লোহানী; খ্যাতনামা প্রকৌশলী, গবেষক, শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, তথ্য-প্রযুক্তিবিদ জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী; লেখক, গবেষক ও সাংবাদিক সৈয়দ আবুল মকসুদ; প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক; বিশ্লেষক ও গবেষক অধ্যাপক তারেক শামসুর রেহমান, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন, নারীনেত্রী আয়শা খানম, জনকণ্ঠ সম্পাদক আতিকউল্লাহ খান মাসুদ, সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক খন্দকার মুনীরুজ্জামান, লেখক খন্দকার মাহমুদুল হাসান, অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও চিত্রশিল্পী সৈয়দ লুৎফুল হকের মতো কীর্তিমানরা। এর মধ্যে এইচ টি ইমাম ও রাবেয়া খাতুনের মৃত্যু বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায়; সৈয়দ আবুল মকসুদ ও আতিকউল্লাহ খান মাসুদ আকস্মিক শ্বাসকষ্টে এবং খন্দকার মাহমুদুল হাসান শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে মারা যান। শিল্প-সাহিত্যের গুণীজনদের মধ্যে জাতি যাঁদের হারিয়েছে তাঁরা হলেন চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর, কবি ও গবেষক মনজুরে মওলা, কবি বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, কথাসাহিত্যিক ও গবেষক রশীদ হায়দার, সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক রাহাত খান, সাহিত্য সম্পাদক আবুল হাসনাত প্রমুখ। দেশবরেণ্য মানুষের মধ্যে হারিয়েছি ভাষাসংগ্রামী ডা. সাঈদ হায়দার, ডা. মির্জা জলিল, শিক্ষাবিদ সুফিয়া আহমেদ, বিজ্ঞানী ড. আলী আসগর, সেক্টর কমান্ডার আবু ওসমান চৌধুরী, সি আর দত্ত, জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার নুরুল হক মানিক প্রমুখ। সংস্কৃতি ও বিনোদন জগতে হারিয়েছি ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খান, সুরকার আজাদ রহমান, অভিনেতা আলী যাকের, সংগীতশিল্পী এন্ড্রু কিশোর প্রমুখকে। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ও এক্সপ্রেশন্স লিমিটেডের উদ্যোক্তা পরিচালক জিয়াউদ্দিন তারিক আলী; রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) সাবেক অধ্যাপক একুশে পদকপ্রাপ্ত ড. মজিবর রহমান; রাবির প্রথম ইমেরিটাস অধ্যাপক এ বি এম হোসেন; বাংলা ভাষার গবেষক, সম্পাদক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ভুঁইয়া ইকবাল; বিশিষ্ট সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান; সময়ের আলোর নগর সম্পাদক হুমায়ুন কবীর খোকন; একুশে পদকপ্রাপ্ত অধ্যাপক মনসুর উল করিমকে কেড়ে নিয়েছে করোনা। স্বল্পতম সময়ে এত এত গুণী ও আলোকিত মানুষের মৃত্যু মুক্তিযুদ্ধের পর আর ঘটেনি। বুদ্ধিবৃত্তিকশূন্যতা এর আগে দেখা দিয়েছিল ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, সাংবাদিক ও পেশাজীবীদের হত্যা করেছিল বেছে বেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক নেহাল করিম বলেন, ‘জাতির আলোকিত মানুষদের মৃত্যুতে যে বিরাট শূন্যতা তৈরি হয়েছে তা সহজে পূরণ হবে না। কবে এ শূন্যতা পূরণ হবে জানি না। মৃত্যুর এ দীর্ঘ মিছিল শেষ হবে কবে জানি না।’

সাহিত্যিক ও শিক্ষক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা এখন সে রকম বুদ্ধিজীবী পাচ্ছি না যাদের শক্তির কেন্দ্রগুলো অপছন্দ করলেও সমীহ করা যায়। পেশাজীবীরা দলীয়ভাবে বিভক্ত হয়ে গেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষকরাও বিভক্ত। সত্যিকারের বুদ্ধিজীবীরা বিভিন্ন পন্থায় অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে কথা বলেন।’

সর্বশেষ খবর