রবিবার, ২৯ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

বাড়ছে নদ-নদীর পানি বন্দী লাখো মানুষ

নিজস্ব প্রতিবেদক

বাড়ছে নদ-নদীর পানি বন্দী লাখো মানুষ

ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে পানিতে তলিয়ে গেছে ঘরবাড়ি-বাংলাদেশ প্রতিদিন

দিন দিন বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-মধ্যাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলের ১২ জেলার বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতির শঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া দেশের আটটি নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কুড়িগ্রাম-লালমনিরহাটে তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র ও ধরলা এবং সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া আরও কিছু নদ-নদীর পানির সমতল বাড়ছে। গতকাল পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্যে বলা হয়েছে- আগামী ২৪ ঘণ্টায় কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, শরীয়তপুর ও চাঁদপুরে নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হতে পারে।

আগামী ২৪ ঘণ্টায় রংপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায় এবং ঢাকা, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হওয়া বয়ে যেতে পারে। সেই সঙ্গে বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। তবে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি থেকে ভারী বর্ষণ হতে পারে বলে জানিয়েছে আবহওয়া অধিদফতর।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বৃষ্টিপাত ও নদ-নদীর অবস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদ-নদীর পানি বাড়ছে, যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। গঙ্গা নদীর পানি কমছে, যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। অন্যদিকে পদ্মা নদীর পানি স্থিতিশীল রয়েছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, পদ্মার পানি আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বাড়তে পারে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আপার মেঘনা অববাহিকার কুশিয়ারা ছাড়া প্রধান নদীগুলোর পানি কমছে। পানি কমার এ ধারা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে।

যমুনায় পানি বৃদ্ধি অব্যাহত : যমুনা নদীর পানি সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় নতুন নতুন অঞ্চল প্লাবিত হয়ে পড়ছে। বর্তমানে যমুনার পানি বিপদসীমার ২৭ সে.মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বাড়ায় নিম্নাঞ্চালের বসতভিটা তলিয়ে যাচ্ছে। ঘরবাড়িতে পানি ওঠায় বন্যাকবলিতরা ওয়াপদা বাঁধে আশ্রয় নিতে শুরু করেছে। অনেকে পানির মধ্যেই মানবেতরভাবে জীবনযাপন করছে। বন্যা কবলিত এলাকায় বিশুদ্ধ পানির চরম সংকট দেখা দিয়েছে। টয়লেট তলিয়ে যাওয়ায় নারীরা চরম কষ্টে পড়েছেন। চুলা তলিয়ে যাওয়ায় রান্না নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। সারাক্ষণ পানিতে থাকায় হাত-পায়ে ঘা দেখা দিয়েছে। ফসল তলিয়ে যাওয়ায় কৃষকের চরম ক্ষতি হয়েছে।

এক সপ্তাহ বাড়েনি পদ্মার পানি : পদ্মা নদীর রাজশাহী পয়েন্টে টানা এক সপ্তাহ ধরেই পানি বাড়েনি। গত ২১ আগস্ট থেকেই পানি কমছে। তবে আবার পানি বাড়তে পারে বলেও মনে করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। রাজশাহী পাউবোর গেজ রিডার এনামুল হক জানান, প্রতিদিন তিনি রাজশাহী নগরীর বড়কুঠি পয়েন্টে পদ্মার পানির উচ্চতা পরিমাপ করেন। গত ২০ আগস্ট এখানে সর্বোচ্চ পানির উচ্চতা ছিল ১৭ দশমিক ৮৫ মিটার। পরদিন ২১ আগস্ট সন্ধ্যায় পানি কমে হয় ১৭ দশমিক ৮২ মিটার। এরপর আর পানি বাড়েনি। শনিবার দুপুর ১২টায় পানির উচ্চতা পাওয়া গেছে ১৬.৯০ মিটার। শুক্রবার ছিল ১৭.০০ মিটার। এর আগে ভোর ৬টায় উচ্চতা ছিল ১৭ দশমিক ০৪ মিটার। রাজশাহীতে পদ্মার পানির বিপৎসীমা ১৮ দশমিক ৫০ মিটার।

পানি কমা-বাড়ার আতঙ্কে তিস্তা পাড়ের মানুষ : রংপুরে তিস্তা পাড়ের মানুষ পানি কমা-বাড়ার মধ্যেই আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। পানি কিছুটা কমলেও গঙ্গাচড়ার ৩টি ইউনিয়নের কয়েক হাজার পরিবার এখনো পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছেন। শনিবার সকাল ৬টায় তিস্তা নদীর পানির ডালিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ১৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। তবে পানি কমার সঙ্গে বিনাবিনার চরসহ কিছু এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। পানি বৃদ্ধি পেলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা মাইকিং করে জনগণকে সতর্ক করছেন এবং নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন।

মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে কয়েকটি ইউনিয়ন : উজান থেকে নেমে আসা বন্যার পানির স্রোত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভয়াবহ হয়ে উঠেছে ঝালকাঠির সুগন্ধা ও বিষখালী নদীর ভাঙন। মানচিত্র থেকে কয়েকটি ইউনিয়ন হারিয়ে যেতে বসেছে। কয়েক যুগ ধরে ভাঙনের ফলে হাজার হাজার একর জমি নদীতে বিলীন হয়ে লক্ষাধিক মানুষ তাদের ভিটামাটি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে। কিছু পরিবার সরকারি খাস জমি বরাদ্দ পেলেও সরকারি নিয়মনীতির ধাপ অনুসরণ করতে না পারায় নিজ দেশে যেন পরবাসী হয়ে আছে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু গ্রাম নদীভাঙনে হারিয়ে গেছে।

ফরিদপুরে বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে

ফরিদপুরের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। গত দুই দিন বন্যার পানি না বাড়লেও শুক্রবার রাত থেকে সকাল পর্যন্ত দুই সেন্টিমিটার পানি কমেছে। যদিও রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ পয়েন্টে পদ্মার পানি এখনো বিপৎসীমার ৪৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যার পানিতে এখনো প্লাবিত রয়েছে ফরিদপুর সদর উপজেলার ডিক্রিরচর, নর্থ চ্যানেল, চরমাধবদিয়া ও আলিয়াবাদ ইউনিয়নের অর্ধশতাধিক গ্রাম। এ ছাড়া চরভদ্রাসন, সদরপুর ও ভাঙা উপজেলার শতাধিক গ্রাম প্লাবিত থাকায় এসব গ্রামের ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছেন। বন্যার পানি কমতে থাকায় মানুষের মধ্যে দুর্ভোগ বেড়েছে। প্লাবিত এলাকাসমূহের মধ্যে কয়েকটি গ্রামের মানুষের মধ্যে অল্প কিছু ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হলেও বেশির ভাগ মানুষই ত্রাণের আওতায় আসেনি।

পানিবৃদ্ধি অব্যাহত : উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল আর থেমে থেমে বর্ষণে লালমনিরহাটে তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। জেলার হাতিবান্ধায় অবস্থিত তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হলেও অন্য দুটি পয়েন্টে তিস্তার নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় জেলার সব নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে ক্রমশ নদী-তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে।

টানা বর্ষণে ফের প্লাবিত হালুয়াঘাট : মাত্র দুই মাসের মাথায় আবারও প্লাবিত হয়েছে ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী উপজেলা হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়ার ৩৭০ হেক্টর ফসলি জমি। একই সঙ্গে পানিবন্দী হয়েছে দুই উপজেলার অন্তত ৩০ গ্রামের মানুষ।

টাঙ্গাইলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি :  টাঙ্গাইলে যমুনা, ধলেশ্বরী ও ঝিনাই নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে জেলায় বন্যা পরিস্থিতির ক্রমেই অবনতি হচ্ছে। বাঁধ উপচে পানি প্রবেশ করে তলিয়ে যাচ্ছে একের পর এক নিম্নাঞ্চল। ক্ষতি হচ্ছে ফসলের। বিভিন্ন স্থানে দেখা দিয়েছে নদীভাঙন। 

পানিবন্দী ২৫ হাজার মানুষ : অতিবৃষ্টি এবং পাহাড়ি ঢলে কুড়িগ্রামে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। গতকাল বিকাল ৩টায় স্থানীয় পাউবোর তথ্য মতে, ধরলা নদীর পানি  সেতু পয়েন্টে বিপৎসীমার ৩৪ সে.মি এবং ব্রহ্মপুত্র নদের চিলমারী পয়েন্টে ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। তিস্তা নদীর পানিও সেতু পয়েন্টে ৫ সেন্টিমিটার নিচে অবস্থান করছে।

সর্বশেষ খবর