বুধবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

আফগান ছাড়ল মার্কিন সেনারা

গুলি ছুড়ে তালেবানদের উল্লাস, আমেরিকানরা নিজেরাই নষ্ট করল সব সরঞ্জাম

প্রতিদিন ডেস্ক

আফগান ছাড়ল মার্কিন সেনারা

মার্কিন বাহিনী চলে যাওয়ায় রাস্তায় আনন্দ উল্লাস করছেন তালেবান যোদ্ধারা -এএফপি

২০ বছর চলা যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে আফগানিস্তান থেকে সব সেনা প্রত্যাহার সম্পন্ন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে তালেবান ফের আফগানিস্তানের ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ায় তাড়াহুড়া করে ও অপমানজনকভাবে দেশটি থেকে সেনা প্রত্যাহারে বাধ্য হয় ওয়াশিংটন ও এর ন্যাটো মিত্ররা। দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে আকাশপথে মার্কিন নাগরিক, অন্য দেশগুলোর নাগরিক ও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে কাজ করার কারণে ঝুঁকিতে থাকা বহু আফগানকে সরিয়ে নেওয়ার পর প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যেই সেনা প্রত্যাহার শেষ করে ওয়াশিংটন ও ন্যাটো মিত্ররা। এরপরও পশ্চিমা দেশগুলোকে সহায়তা করা ও সরিয়ে নেওয়ার যোগ্য প্রায় লাখো আফগান রয়ে গেছে। বিবিসি জানিয়েছে, মার্কিন সেনাবাহিনীর ১৮ এয়ারবোর্ন কোরের ৮২তম এয়ারবোর্ন ডিভিশনের কমান্ডার মেজর জেনারেল ক্রিস ডনাহিউ যুক্তরাষ্ট্রের শেষ সৈন্য হিসেবে আফগানিস্তানের মাটি ছাড়েন। এদিকে পেন্টাগনে এক ব্রিফিংয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল কমান্ডের কমান্ডার জেনারেল ফ্রাঙ্ক ম্যাকেনজি জানান, কাবুলের স্থানীয় সময় সোমবার রাত ১১টা ৫৯ মিনিটে ছেড়ে আসা শেষ সি-১৭ ফ্লাইটে ছিলেন আফগানিস্তানে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত রস উয়িলসন। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনীতে থাকা প্রতিটি সদস্য এখন আফগানিস্তানের বাইরে। শতভাগ নিশ্চিত করে এটি বলতে পারি আমি।’ ‘এই প্রস্থানের সঙ্গে অনেক হৃদয়বিদারক ঘটনা যুক্ত রয়েছে। যাদের সরিয়ে আনতে চেয়েছিলাম তাদের সবাইকে আনতে পারিনি আমরা। কিন্তু আমার মনে হয়, যদি আরও ১০ দিনও থাকতাম তবুও সবাইকে নিয়ে আসতে পারতাম না আমরা।’ কাবুলে ২০০ মার্কিন নাগরিককে ফেলে গেছে যুক্তরাষ্ট্র : বার্তা সংস্থা এপির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্কিন সামরিক বাহিনী চূড়ান্তভাবে আফগান ভূখন্ড ছাড়লেও কাবুলে প্রায় ২০০ মার্কিন নাগরিককে ফেলে রেখে গেছে যুক্তরাষ্ট্র। একই সঙ্গে দেশ ছাড়তে ইচ্ছুক হাজার হাজার আফগান নাগরিককেও ফেলে রেখে গেছে দেশটি। কাবুল ছাড়ার জন্য তাদের এখন তালেবানের অনুমতির ওপর নির্ভর করতে হবে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র চূড়ান্তভাবে আফগানিস্তান ছাড়লেও দেশটিতে থাকা মার্কিন নাগরিক ও আফগানদের বের করে আনতে চেষ্টা চালিয়ে যাবে ওয়াশিংটন। এ ছাড়া কাবুল বিমানবন্দর ফের চালু হলে বিমানের মাধ্যমে বা স্থলপথে তাদের বের করে আনতে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিবেশীদের সঙ্গে কাজ করবে বলেও জানিয়েছেন তিনি। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন কাবুলের মার্কিন কূটনৈতিক মিশন স্থগিত করে দোহায় নিয়ে যাওয়া হলেও, মার্কিন নাগরিক এবং যে আফগানদের যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্ট রয়েছে, তারা চাইলে তাদের আফগানিস্তান ছাড়তে সহায়তা করা হবে।

মার্কিন সেনাদের বিদায়ে কাবুল বিমানবন্দরে তালেবান যোদ্ধাদের উচ্ছ্বাস : যুক্তরাষ্ট্রের শেষ সামরিক বিমানটি আফগানিস্তান ত্যাগের পর উদযাপনে মেতে ওঠে তালেবান যোদ্ধারা। মার্কিন সেনারা চলে যাওয়ার পরপরই বিমানবন্দরে প্রবেশ করে তারা। এ সময় সেখানে ফাঁকা গুলিবর্ষণ করে। অনেককে আল্লাহর প্রতি শুকরিয়া জানিয়ে আলহামদুলিল্লাহ বলতে শোনা যায়। বিমানবন্দরের বাইরেও কাবুলের বিভিন্ন স্থানে তালেবান সদস্যদের বিজয় উদযাপন করতে দেখা গেছে। সর্বত্র যেন উৎসবের আমেজ।

বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্ব পেয়েছে তালেবানের বদরি ৩১৩ ব্রিগেড। অত্যাধুনিক বন্দুক, হেলমেটে নাইট ভিশন ক্যামেরা নিয়ে একেবারে সামরিক কায়দায় তল্লাশি চালায় তারা। আফগান বাহিনীর বিমানের ককপিঠে উঠেও পরীক্ষা চালায়। লস অ্যাঞ্জেলস টাইমসের একজন সাংবাদিক তালেবান যোদ্ধাদের সেই তল্লাশি অভিযানের ভিডিও শেয়ার করেছেন টুইটারে। এতে দেখা যায়, রাতের অন্ধকারে সামরিক পোশাকে বেশ কয়েকজন তালেবান যোদ্ধা ঢুকে পড়ে বিমানবন্দর চত্বরে। সেখানে মার্কিন বাহিনীর রাখা একটি চিনুক হেলিকপ্টার ভালোভাবে খতিয়ে দেখেন তারা।

মার্কিন বাহিনী বিমানবন্দর ছেড়ে যাওয়া ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই এয়ারপোর্টের রানওয়েতে পৌঁছান দলের মুখপাত্র জবিউল্লাহ মুজাহিদ। তিনি বলেন, ‘আফগানিস্তানকে অভিনন্দন। এই বিজয় আমাদের সবার। আমরা যুক্তরাষ্ট্রসহ পুরো দুনিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে চাই। সবার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী।’ যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিনকেন জানিয়েছেন, তালেবান তাদের বিরোধীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ না নিলে যুক্তরাষ্ট্র নতুন তালেবান সরকারের সঙ্গে কাজ করার জন্য প্রস্তুত থাকবে।

কাবুলে বিমান, অস্ত্র অকেজো করে রেখে গেছে মার্কিন বাহিনী : কাবুল বিমানবন্দর ছাড়ার আগে সেখানে থাকা এয়ারক্রাফট, সাঁজোয়া যান ও উচ্চ প্রযুক্তির রকেট ডিফেন্স সিস্টেম অকার্যকর করে রেখে যাওয়ার কথা নিশ্চিত করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী। মিশন কমান্ডার জেনারেল কেনেথ ম্যাকেনজি পেন্টাগনের এক ব্রিফিংয়ে জানান, মার্কিন সেনারা কাবুল বিমানবন্দরে রয়ে যাওয়া ৭৩ এয়ারক্রাফট, ৭০টি সাঁজোয়া যান এবং ২৭টি হামভি গাড়ি ‘অকার্যকর’ করে রেখে গেছে। তালেবানরা যেন এগুলো ব্যবহার করতে না পারে তা নিশ্চিত করতেই এমনটি করা হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন। ‘ওইসব এয়ারক্রাফট আর কখনই ওড়ানো যাবে না। কেউ কখনই সেগুলো চালাতে পারবে না,’ বলেছেন তিনি। বিবিসি জানিয়েছে, মার্কিন সেনারা বিমানবন্দটিতে মোতায়েন করা উচ্চ প্রযুক্তির রকেট ডিফেন্স (সি-আরএএম) সিস্টেমও অকার্যকর করে রেখে গেছে। এই সি-আরএএম সিস্টেম সোমবার কাবুল বিমানবন্দরে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) রকেট হামলা প্রতিরোধ করতে ব্যবহৃত হয়েছিল।

এর আগে তালেবান যোদ্ধাদের যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি বিভিন্ন সামরিক যান ও অস্ত্র ব্যবহার করতে দেখা গেছে। ওইসব সামরিক যান ও অস্ত্র আফগান সামরিক বাহিনীকে সরবরাহ করেছিল ওয়াশিংটন, কিন্তু ওই বাহিনীর সদস্যরা আত্মসমর্পণ করার পর তাদের অত্যাধুনিক অস্ত্রগুলো তালেবান যোদ্ধাদের হাতে চলে যায়।

চীন-রাশিয়াকে আফগান আলোচনায় চায় জার্মানি : জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য দুটি দেশের দূতাবাস এখনো কাবুলে খোলা। সে দুটি দেশ হলো চীন এবং রাশিয়া। পশ্চিমা দেশগুলোর অভিযোগ, দুটি দেশই নিজেদের মতো করে তালেবানের সঙ্গে একপ্রকার রফাসূত্রে পৌঁছেছে। সে কারণেই তারা এখনো সেখানে দূতাবাস খোলা রেখেছে।

জাতিসংঘের জরুরি বৈঠকে এই দুই দেশকে সবার সঙ্গে আলোচনায় যোগ দিতে আহ্বান জানিয়েছেন জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাইকো মাস। অন্যদিকে, চার দিনের পাঁচ দেশ সফরে সোমবার হাইকো মাস কথা বলেছেন উজবেকিস্তানের প্রশাসনের সঙ্গে। মাস জানিয়েছেন, জার্মানিতে আফগান শরণার্থী পাঠানোর বিষয়ে উজবেকিস্তান সাহায্য করবে বলে জানিয়েছে। উজবেকিস্তান জানিয়েছে, আফগান শরণার্থীদের তাদের দেশের মাধ্যমে জার্মানিতে পাঠানোর ব্যবস্থা তারা করবে। আফগানিস্তানের সঙ্গে উজবেকিস্তানের সীমান্ত আছে। সেই সীমান্ত দিয়ে কীভাবে আফগান শরণার্থীদের উজবেকিস্তানে নিয়ে আসা হবে, সে বিষয়ে অবশ্য কোনো পক্ষই কিছু জানায়নি। তবে উজবেকিস্তান জানিয়েছে, প্রাথমিকভাবে আফগান শরণার্থীদের তাদের দেশে জায়গা দেওয়া হবে। তারপর কাগজপত্র পরীক্ষা করে তাদের জার্মানি এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে।

অধিকাংশ পশ্চিমা দেশ একত্রে বৈঠক করে আফগানিস্তান নিয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিতে চাইছে। জাতিসংঘে ইতিমধ্যেই একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়েছে। কিন্তু সেখানে চীন এবং রাশিয়ার অবস্থান স্পষ্ট নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ। এই পরিস্থিতিতে মাস চাইছেন রাশিয়া এবং চীনও এ বিষয়ে সহযোগিতা করুক। কারণ আফগান প্রশ্নে রাশিয়া এবং চীনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। প্রসঙ্গত, তালেবান কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার এক দিন আগে ১৪ আগস্ট থেকে ৩০ আগস্ট পর্যন্ত আকাশপথে ১ লাখ ২২ হাজারেরও বেশি লোককে সরিয়ে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্ররা। ২০ বছরের আফগান যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় আড়াই হাজার সেনা ও ২ লাখ ৪০ হাজার আফগানের প্রাণ নিয়েছে এবং এতে ব্যয় হয়েছে প্রায় দুই ট্রিলিয়ন ডলার।

সর্বশেষ খবর