বুধবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

দীর্ঘদেহী কর্মকর্তা পেতে বিশেষ বিসিএসসহ নানা প্রস্তাব পুলিশের

আলাউদ্দিন আরিফ

দীর্ঘদেহী ও অধিকতর যোগ্য কর্মকর্তা পেতে বিশেষ বিসিএসসহ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব পাঠিয়েছে পুলিশ সদর দফতর। এতে বিসিএস পুলিশ সদস্যদের জন্য ন্যূনতম উচ্চতা ধরা হয়েছে পুরুষ ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি ও নারী ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি। অপরাধীদের মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় সক্ষমতা ও শারীরিকভাবে যোগ্য কর্মকর্তার কথাও বলা হয়েছে প্রস্তাবে। এর আগে পুলিশ সদর দফতরের প্রস্তাব অনুযায়ী, সাব ইন্সপেক্টর (এসআই) ও কনস্টেবল নিয়োগে ন্যূনতম উচ্চতা পুরুষদের ক্ষেত্রে ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি ও নারীদের ক্ষেত্রে ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি  নির্ধারণ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে পুলিশের এই প্রস্তাব প্রজ্ঞাপন আকারে জারি হয়েছে; যা পরবর্তী নিয়োগ থেকে কার্যকর হবে। এখন তারা ক্যাডার কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রেও একই উচ্চতাসহ অধিকতর যোগ্য প্রার্থী নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। সেজন্য প্রয়োজনীয় শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে করার কথা বলা হয়েছে প্রস্তাবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের ডিআইজি (অপারেশন, মিডিয়া অ্যান্ড প্ল্যানিং) মো. হায়দার আলী খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘পুলিশ বাহিনীতে ক্যাডার কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও যুগোপযোগী করার জন্য নির্ণয় করে সুনির্দিষ্ট একটি প্রস্তাব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। ২০৪১ সালে আমরা প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত রূপকল্প বাস্তবায়ন এবং আমরা যখন উন্নত বিশ্বের কাতারে যাব তখন জনগণ প্রত্যাশা করবে উন্নত পুলিশ। এখনো জনসাধারণ সেটা প্রত্যাশা করে। ২০৪১ সালে যখন দেশ উন্নত বিশ্বের কাতারে প্রবেশ করবে তখন অর্থাৎ ২০৪০ সালে চাইলেই উন্নত পুলিশ পাওয়া যাবে না। সেটা পর্যায়ক্রমে এখন থেকেই করতে হবে। সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাকে উন্নত প্রশিক্ষণ দিতে হবে; উন্নত অস্ত্র, যানবাহন দেওয়া ও তার মানসিকতা উন্নত করাসহ যা যা প্রয়োজন সবই করতে হবে। এসব কিছু বিবেচনায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ভিশন যেটা আছে সেটা বাস্তবায়নে পুলিশের কর্মকর্তা লেভেলেও নিয়োগবিধি পরিবর্তন সংক্রান্ত একটা প্রস্তাব পাঠিয়েছি।’ বিশেষ বিসিএসের প্রস্তাব পাঠানো প্রসঙ্গে হায়দার আলী খান বলেন, ‘পুলিশের জন্য একটি বিশেষ বিসিএস হতে পারে। ইতোপূর্বেও হয়েছে। শুধু পুলিশ নয় অন্যান্য ক্যাডারের জন্য বিশেষ বিসিএস হচ্ছে।’ 

পুলিশ সদর দফতরের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বর্তমানে ক্যাডার কর্মকর্তাদের ন্যূনতম উচ্চতা পুরুষদের জন্য ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি এবং নারীদের জন্য ৫ ফুট। শারীরিকভাবে অধিক উপযুক্ত এবং যোগ্য ক্যাডার অফিসার পেতে এর পরিবর্তে পুরুষদের জন্য ন্যূনতম ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি এবং মহিলাদের জন্য ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি করতে বলা হয়েছে। আরও বলা হয়েছে, মেধাবী, বিচক্ষণ, সাহসী, সুঠাম দেহী ও বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বরের অধিকারী কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়ার বিষয়। এ ছাড়া প্রস্তাবে আবেদনকারীর যোগ্যতায় অবশ্যই অবিবাহিত হতে বলে বলা হয়। রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে ক্যাডার কর্মকর্তাদের মেডিকেল পরীক্ষার কথা বলা হয়েছে। বর্তমানে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অধীনে সরকারি হাসপাতালগুলোতে পুলিশ এবং অন্যান্য ক্যাডার সার্ভিসে পদপ্রত্যাশীদের মেডিকেল পরীক্ষা হয় এবং সাধারণ বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে পুলিশ সার্ভিসে ক্যাডার কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। পুলিশ সদর দফতরের কর্মকর্তারা বলেন, পুলিশকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতিতে কাজ করতে হয়। মুখোমুখি হতে হয় গুরুতর অপরাধের এবং মোকাবিলা করতে হয় ভয়ানক অপরাধীদের। সেজন্য কর্মকর্তাদের শারীরিকভাবে অধিকতর সক্ষম হওয়া জরুরি।

পুলিশ সদর দফতরের কর্মকর্তারা জানান, সব বিসিএস ক্যাডার পাবলিক সার্ভিস কমিশনের আওতায় সাধারণ বিসিএসের মাধ্যমে নিয়োগ হয়। এতে সব ক্ষেত্রে সুঠাম দেহী, বিচক্ষণ, সাহসী এবং যোগ্য অফিসার পুলিশ ক্যাডারে নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয় না। তাছাড়া পুলিশে এমন কিছু কিছু কর্মকর্তা আছেন যারা কিছু গুরুতর রোগ থাকা সত্ত্বেও নিয়োগ পেয়ে যান। পুলিশে যোগদানের কয়েক বছর পর তারা শারীরিকভাবে অক্ষম ও দায়িত্ব পালনের অযোগ্য হয়ে পড়েন। তাই পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স বিশেষ বিসিএসের মাধ্যমে অফিসার নিয়োগ চাইছে। তাছাড়া বর্তমানে রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালটিতে স্বাস্থ্য পরীক্ষার সর্বাধুনিক সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। তাই সেখানে প্রয়োজনীয় মেডিকেল টেস্ট করে সুস্থ সবল প্রার্থী বাছাই করা সম্ভব। বিবাহিত প্রার্থীদের নিয়োগ না দেওয়ার প্রস্তাবের যৌক্তিকতা তুলে ধরে পুলিশ সদর দফতরের একজন এআইজি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘নিয়োগ পাওয়ার পর একজন সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) তার পূর্ণ মনোযোগ এবং একাগ্রতা, নিষ্ঠার মাধ্যমে নিবিড় প্রশিক্ষণ নিতে হয়। এক বছরের বেশি সময় নিবিড় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাকে যোগ্য ও দক্ষ পুলিশ কর্মকর্তা হতে হয়। কিন্তু বিবাহিতরা স্ত্রী-সন্তান থাকলে প্রশিক্ষণে সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করতে পারেন না। এতে তার প্রশিক্ষণে বিঘ্ন ঘটে।’

পুলিশ সদর দফতরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘বিশেষ বিসিএসের বিষয়টি এখানে মুখ্য নয়। আমরা চাই বিএসএস পরীক্ষায় পুলিশ ক্যাডার নিয়োগের সময় উচ্চতা বৃদ্ধি ও শারীরিক পরীক্ষার বিষয়গুলো প্রতিপালনের বিষয়গুলো নিশ্চিত করা।’ পুলিশ সদর দফতরের প্রস্তাবের বিষয় জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, পুলিশ সদর দফতরের প্রস্তাবটি আংশিক বা পুরোটা বিবেচনায় নিতে হলে বিসিএস নিয়োগবিধিতে সংশোধনী আনতে হবে। আইন, বিধিবিধান স্থায়ী কোনো বিষয় নয়; প্রয়োজনে এগুলোর পরিবর্তন করা চলে। তবে ভাবতে হবে, চাকরিতে আবেদনের বয়স ৩০ বছর চলছে। ইদানীং করোনার জন্য আরও ২১ মাস বাড়ানোর প্রক্রিয়াও চলমান। আবেদনের পর দীর্ঘসূত্রতার জন্য গড়ে চার বছর লেগে যায় চাকরি পেতে। অবশ্য কম বয়সীরাও আবেদন করে টিকে যান অনেকেই। মোটা দাগে বলতে গেলে ৩০-৩৪ বছর বয়সীরা চাকরিতে আসেন প্রায় সব ক্যাডারে। আলোচনায় আসতে পারে পুলিশ ক্যাডারে সূচনা পদে নিয়োগে অবিবাহিত থাকা বাধ্যতামূলক বিধান সংক্রান্ত প্রস্তাবটি। এ ধরনের বিধান গোটা উপমহাদেশে সিভিল সার্ভিসে নজিরবিহীন। তবে সামরিক বাহিনীতে রয়েছে। বর্তমান নিয়মে যে বয়সে বিসিএসের চাকরিতে যাচ্ছে, সে বয়সে কেউ কেউ বিয়ে করে ফেলে। পুলিশ সদর দফতরের মতামত এখানে যথার্থ যে বিবাহিত ও পরিবার-পরিজন নিয়ে নতুন নিয়োগপ্রাপ্তরা চাকরির সূচনায় অখন্ড মনোযোগ দিতে পারেন না। কিছুটা সময় ও মনোযোগ তাদের পরিবারের দিকে যায়। আর এমনই তো চলছে। খুব বড় অসুবিধার কথা তো জানা যায়নি। আর সংখ্যায় অবিবাহিতদের অনুপাত অনেক বেশিই থাকে। এ ক্ষেত্রে পুলিশ ক্যাডার পদে নিয়োগের জন্য বিবাহিত হওয়াকে অযোগ্যতা বলে বিবেচনা করা সমীচীন হবে বলে মনে হয় না। তিনি আরও বলেন, শারীরিক উচ্চতা বাড়ানোর যে প্রস্তাবটি করা হয়েছে, সেটি গুরুত্ব দিয়ে দেখার দাবি রাখে। ভারতে আইপিএসের জন্যও এ ধরনের শারীরিক যোগ্যতা নির্ধারিত আছে। তবে সেটা অনেক শিথিল করা আছে তফসিলি জাতি ও উপজাতির জন্য। উচ্চতাই কঠোর পরিশ্রমের একমাত্র নির্ণায়ক হলে গুর্খারা পৃথিবীর একটি শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা জাতি হিসেবে মর্যাদা পেত না। যা হোক, এ প্রস্তাব নিয়ে তেমন বিতর্ক নেই। প্রশ্ন থাকবে কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল ছাড়া অন্য সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোয় পুলিশ ক্যাডারের সুপারিশকৃতদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে পারবেন না কেন? এসব হাসপাতালে অনেক উঁচু মানসম্পন্ন চিকিৎসকরা কাজ করছেন। সারা দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা তাদের হাতে। এ ক্ষেত্রে তাদের বাদ রাখার যুক্তি যথেষ্ট দুর্বল। তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রতিবেদনের মাধ্যমেই পুলিশ ক্যাডারে নিয়োগ পেয়েছেন অনেক চৌকস কর্মকর্তা। এমনকি বিবেচ্য প্রস্তাবটির যারা সূচনা করেছেন, তারাও। এ-জাতীয় একটি প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থাকে ভেঙে দেওয়া আবশ্যকীয় নয়। তিনি বলেন, তবে এটি বোঝা যাচ্ছে, পুলিশ সদর দফতর যে প্রস্তাবটি দিয়েছে, তা তাদের ক্যাডার সদস্যদের গুণগত মান বৃদ্ধির সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে। আর এ ধরনের মান বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রস্তাব আসতেও পারে। বিসিএস পরীক্ষাও সব সময়ে একই নিয়মে চলবে, এমন নয়। আমরা চাই পুলিশ কর্মকর্তাদের মান উত্তরোত্তর বাড়তে থাকুক।

সর্বশেষ খবর